রায়হান হত্যার সাথে জড়িত থাকার প্রমাণ থাকা সত্বেও জড়িতদের বাঁচাতে পুলিশ লাইন্সে রেখে ‘জামাই আদর’ করা হচ্ছে বলে দাবি করেছেন মা সালমা বেগম। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন আকবর হোসেন ভুইয়াকে। সেই আকবরের রহস্যজনক পালিয়ে যাওয়ার দায় সেই কর্মকর্তারা এড়াতে পারেন না। অভিযুক্তদের পুলিশ লাইন্সে রেখে ‘জামাই আদর’, আকবরের পালিয়ে যাওয়া ও এসএমপির উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতা একই সূত্রে গাঁথা বলে দাবি সালমা বেগমের। অন্যদিকে, আগামী ৭২ ঘন্টার মধ্যে জড়িতদের গ্রেফতার না দেখালে হরতালও কঠোর কর্মসূচি ঘোষণার হুমকি দেয়া হয় এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে।
গতকাল রোববার দুপুরে পুলিশী হেফাজতে নির্যাতনে নিহত রায়হান আহমদের পরিবার ও বৃহত্তর আখালিয়া এলাকাবাসীর উদ্যোগে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানান সালমা বেগম। এ সময় সালমা বেগমের পক্ষে নিহতের মামাতো ভাই শওকত হোসেন লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, রায়হান আহমদকে (৩৩) গত ১১ অক্টোবর রাতে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে ডেকে নিয়ে বর্বর নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে গণমাধ্যমকর্মীরা প্রকৃত তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এলাকাবাসী আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। নিহত রায়হানের মেয়ে শিশু আলফাকে নিয়ে প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি, এরপরও পুলিশের দিল গলানো যাচ্ছে না। উল্টো তারা প্রধান অভিযুক্ত এসআই আকবরকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছে। বাকীদের পুলিশ লাইন্সে রেখে জামাই আদর করা হচ্ছে।
মা সালমা বেগমের আরো দাবি ঘটনার পর বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সাব ইন্সপেক্টর আকবরসহ হত্যাকাণ্ডে জড়িত অন্য পুলিশ সদস্যরা রায়হানকে ছিনতাইকারী সাজিয়ে ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছিলো। গণমাধ্যমের শক্ত অবস্থানের কারণে তা পারেনি।
তিনি বলেন, রায়হানকে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে আটকে রেখে রাতভর নির্মম নির্যাতন করা হয়। রাতেই বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়ির সাব ইন্সপেক্টর তৌহিদ এর মোবাইল ফোন থেকে আমাকে কল করে ১০ হাজার টাকা চাওয়া হয়। রায়হানের দুই হাতের কব্জি ও পায়ের হাড় আঘাতের পর আঘাতে ভেঙ্গে দেয়া হয়। তার হাতের আংগুলের নখ প্লাস দিয়ে টেনে তুলে ফেলা হয়। ঘটনার পর সিলেটবাসীর আন্দোলনের মুখে জড়িতদের সাময়িক ব্যবস্থা নিলেও এখনো তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়নি। হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়নি।
সালমা বেগম আরো দাবি করেন, ঘটনার পরদিন রাতে পুলিশ মামলা নিতে গড়িমসি করে। এরপর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে চিঠি চালাচালির পর অজ্ঞাতনামা আসামী করে মামলাটি নেয়া হয়। এখন পর্যন্ত সেই মামলায় জড়িতদের গ্রেফতার দেখানো হয়নি। সালমা বেগম বলেন, জড়িতদের বাচাঁতে খোদ পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পক্ষপাতমূলক আচরণ করছেন।
লিখিত বক্তব্যে আরো বলা হয়, মামলার তদন্তভার ইতোমধ্যে পুলিশ ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো (পিবিআই)-এর নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে। রায়হানের লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়েছে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ, ওসমানী হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রতিবেদন থাকা স্বত্বেও পিবিআই জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন া। তাকে গ্রেফতার দেখাচ্ছে না। পুরো হত্যাকান্ডটিকে রহস্যাবৃত করে রাখা হয়েছে। মনে হচ্ছে জড়িতদের আড়াল করার ষড়যন্ত্র চলছে। তবে বৃহত্তর আখালিয়া এলাকাবাসী আগামী ৭২ ঘন্টা সময় বেধে দিয়েছে। না হয় সিলেটবাসীকে সঙ্গে নিয়ে হরতালসহ বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এতে উদ্ভূত যে কোন পরিস্থিতির দায়ভার সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কর্তৃপক্ষকে বহন করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলন থেকে বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করা হয়ঃ দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে বিচারবিভাগীয় তদন্ত, রায়হান হত্যায় জড়িত বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ দোষী সকল পুলিশ সদস্যকে অবিলম্বে গ্রেফতার, পুরো ঘটনার ব্যাপারে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার কর্তৃক একটি পূর্ণাঙ্গ বক্তব্য প্রদান, নিহতের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদনসহ আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে এস আই আকবরসহ হত্যায় জড়িত সকল পুলিশ সদস্যকে গ্রেফতার করা না হলে আন্দোলনের হুমকি দেয়া হয়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, স্থানীয় কাউন্সিলর মখলিছুর রহমান কামরান, ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর রেজাউল হাসান কয়েস লোদী, ১০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারেক উদ্দিন তাজ, ৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইলিয়াসুর রহমান, কাউন্সিলর তৌফিক বক্স লিপন, নারী কাউন্সিলর রেবেকা বেগম, সাবেক কাউন্সিলর বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালিক, সাবেক কমিশনার জগদীশ দাশ ও রায়হানের চাচা হাবিবুল্লাহ, ব্যবসায়ী নেতা আমীর হোসেন, এডভোকেট আজিম উদ্দিন, প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনের শেষ মুহূর্তে এসে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ। তিনি বলেন, আমরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করছি যে, ‘সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ সম্প্রতি সিলেটে সংঘটিত নানা ঘটনায় রহস্যজনক আচরণ করছে। যেখানে ধর্ষণ কিংবা অপরাধের জড়িতদের গ্রেফতারের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা থাকা সত্বেও এমসি কলেজে তরুণী ধর্ষণের জড়িতদের গ্রেফতার করতে পারেনি এসএমপি। এ নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। পরে জেলা পুলিশ ও র্যাবের আন্তরিক প্রচেষ্টায় আসামীরা ধরা পড়ে। মিসবাহ সিরাজের অভিযোগ, রায়হান হত্যাকান্ডেও এসএমপি চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছে। গুঞ্জন রয়েছে, প্রধান অভিযুক্ত একজন সাবইন্সপেক্টরকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করা হয়েছে। মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ এসএমপির কমিশনারকে রায়হান হত্যাকান্ড নিয়ে পুলিশের ভূমিকা পরিষ্কার করার দাবি জানান। তিনি অনতিবিলম্বে পলাতক আকবরসহ জড়িতদের গ্রেফতার দেখিয়ে আইনের আওতায় নিয়ে আসার দাবি জানান।
প্রসঙ্গত, গত ১১ অক্টোবর ভোরে পুলিশের নির্যাতনে রায়হান উদ্দিন (৩৩) নামে এক যুবক নিহত হওয়ার অভিযোগ তুলেছেন তার স্বজনরা। নিহত ওই যুবক সিলেটের আখালিয়ার নেহারিপাড়ার মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে।
পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ছিনতাইকালে গণপিটুনিতে মারা গেছেন রায়হান। তবে নিহতের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, পুলিশ ধরে নিয়ে নির্যাতন করে রায়হানকে হত্যা করেছে। পরিবারের অভিযোগে ভিত্তিতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ।
এদিকে, রোববার দিবাগত রাতে নিহত রায়হানের স্ত্রী বাদী হয়ে অজ্ঞাত কয়েকজন আসামি করে কোতোয়ালী থানায় মামলা দায়ের করেছেন। বর্তমানে চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি তদন্ত করছে পিবিআই।