আগামী ৫ ডিসেম্বর সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন। সম্মেলনের তারিখ ঘনিয়ে আসতেই শুরু হয়েছে পদপ্রত্যাশীদের দৌঁড়ঝাপ। সম্মেলনকে ঘিরে নেতাকর্মীদের মাঝে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। এখন থেকেই সিলেট নগরী উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়েছে। ওয়ার্ড কমিটির কাউন্সিলারদের ‘ম্যানেজ’ করার চেষ্টার পাশাপাশি চলছে কেন্দ্রে লবিং। দীর্ঘ ১৪ বছর পর সম্মেলন আয়োজন হওয়ায় নেতাকর্মীদের মাঝেও দেখা দিয়েছে উচ্ছ্বাস। সেই সাথে সম্মেলনের মাধ্যমে ৮ বছরের পুরনো শীর্ষ নেতৃত্বে পরিবর্তন আসছে কি-না এ নিয়েও চলছে সিলেটজুড়ে নানা আলোচনা।
আওয়ামী লীগ দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হতে এ পর্যন্ত ১৫ নেতার নাম আলোচনায় রয়েছে। এর মধ্যে সভাপতি পদে ৫ জন ও সাধারণ সম্পাদক পদের জন্যে ১০ নেতা তৎপর বলে জানা গেছে। পদ প্রত্যাশীদের সকলেই মহানগর আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির বিভিন্ন পদে রয়েছেন। সভাপতি পদে বর্তমান সভাপতি ও দলের কেন্দ্রীয় সদস্য বদর উদ্দিন আহমদ কামরান, বর্তমান সহ-সভাপতি এডভোকেট মফুর আলী, সহ-সভাপতি এডভোকেট রাজ উদ্দিন, সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালিক ও বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদের নাম সর্বত্র শোনা যাচ্ছে।
সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য বর্তমান কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল আনোয়ার আলাওর, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিজিত চৌধুরী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক তপন মিত্র, বন ও পরিবেশ সম্পাদক জগদীশ চন্দ্র দাস, শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক আজাদুর রহমান আজাদ, সাংস্কৃতিক সম্পাদক প্রিন্স সদরুজ্জামান চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল ও এ টি এম হাসান জেবুল এবং সদস্য সালেহ আহমদ সেলিমের নাম শোনা গেছে। পদ প্রত্যাশী ১৫ জনের মধ্যে বিগত বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে বার বার জঙ্গীদের টার্গেটের শিকার হন বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। এডভোকেট মফুর আলী, এডভোকেট রাজ উদ্দিন, ফয়জুল আনোয়ার আলাওর, অধ্যাপক জাকির হোসেন, তপন মিত্র, এ টি এম হাসান জেবুল গ্রেনেড হামলায় আহত হন। ২০১১ সালের কমিটিতে এ সকল নেতার নামের পার্শ্বে ‘গ্রেনেড হামলায় আহত’ লেখা রয়েছে। পদ প্রত্যাশীরা স্থানীয় কাউন্সিলরদের মন জয়ের পাশাপাশি কেন্দ্রের সাথেও জোর লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন।
২০০৫ সালের পর ১৪ বছরের ব্যবধানে আবারো মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এজন্যে নেতাকর্মীদের মাঝে আবেগ-উচ্ছ্বাসের কোনো কমতি নেই। নগর জুড়ে বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ। ২০০৫ সালের সম্মেলন শেষে বদর উদ্দিন আহমদ কামরানকে সভাপতি ও মিসবাহ উদ্দিন সিরাজকে সাধারণ সম্পাদক করে নগর আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করা হয়। ২০০৯ সালের জাতীয় কাউন্সিলে মিসবাহ উদ্দিন সিরাজকে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়। এরপর ২০১১ সালে সম্মেলন ছাড়াই ৭১ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন দেন দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বদর উদ্দিন আহমদ কামরানকে পুনরায় সভাপতি ও আসাদ উদ্দিন আহমদকে এ কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। এরপর এ কমিটি নগরের ২৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২১ ওয়ার্ডের সম্মেলন ও কমিটি গঠন করে। গত কয়েক মাস আগে কেন্দ্রের কঠোর নির্দেশের পর ১০ অক্টোবর নগর আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটি বৈঠক করে ৬ ওয়ার্ডের সম্মেলনের তারিখ ধার্য্য করে। পাশাপাশি এ সভায় নগর সম্মেলনের জন্যে ৩০ নভেম্বর সম্ভাব্য দিন নির্ধারণ করা হয়। পরে কেন্দ্রের সাথে আলোচনা করে ৫ ডিসেম্বর সম্মেলনের দিন চূড়ান্ত করা হয়। দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইতোমধ্যে ৬টি ওয়ার্ডের সম্মেলন সম্পন্নের ফলে ২৭ ওয়ার্ডের সম্মেলন সফলভাবেই শেষ করে নগর আওয়ামী লীগ। বর্তমানে সম্মেলন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পুরোদমে প্রস্তুতি চলছে। আগামী ৫ ডিসেম্বর সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে জেলা ও মহানগর শাখার ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। ইতোমধ্যে মাদ্রাসা মাঠের আশপাশ এলাকা ব্যানার-বিলবোর্ডে ছেয়ে গেছেদলের নেতৃত্ব নির্বাচনে নগর আওয়ামী লীগে রয়েছেন ৪১০ কাউন্সিলর।
বিগত সিটি করপোরেশন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং দলীয় কার্যক্রম বিবেচনায় এই আলোচনার শীর্ষে রয়েছেন সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদর উদ্দিন আহমদ কামরান, সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ এবং শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক ও সিলেট সিটি করপোরেশনের চারবারের কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ। অতীত কর্মকান্ড বিবেচনায় এবার পদোন্নতি পেতে পারেন এই তিন নেতা- এমনটাই মনে করছেন দলের নেতাকর্মীরা।
আর নেতাকর্মীদের এই ধারণা বাস্তব রূপ পেলে সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে পদোন্নতি পেয়ে মহানগর সভাপতির পদে আসীন হতে পারেন আসাদ উদ্দিন আহমদ। আর তার স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন আজাদুর রহমান আজাদ। দীর্ঘদিন থেকে সিলেটবিভাগজুড়ে দলীয় কার্যক্রমে নিজেকে ব্যস্ত রাখার পুরস্কার হিসেবে মহানগর সভাপতি পদ থেকে পদোন্নতি পেয়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামে দেখা যেতে পারে কামরানকে- এমন গুঞ্জন চলছে নগরজুড়ে। বর্তমানে সিলেট মহানগরের সভাপতির পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সদস্যের দায়িত্ব পালন করছেন কামরান।
সম্মেলন ঘনিয়ে আসায় শীর্ষ পদপ্রত্যাশীদের ‘আমলনামা’ এখন আলোচিত হচ্ছে নেতাকর্মীদের মুখে মুখে। সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে বিগত সিটি ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এসব পদপ্রত্যাশীদের ভূমিকা। গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে পরাজিত হন বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। এই নির্বাচনে পরাজয়ের জন্য দলের কয়েকজন নেতার বিতর্কিত ভূমিকাকে দায়ি করা হয়। ওই নির্বাচনে ২০, ২১ ও ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের দলীয় সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিলেন আজাদুর রহমান আজাদ।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অনেক নেতার নিজের কেন্দ্রে নৌকা প্রতীক পরাজিত হলেও এই তিন ওয়ার্ডের সবকটি কেন্দ্রে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন কামরান। একইভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এই তিন ওয়ার্ডে দলীয় প্রার্থী ড. এ কে আবদুল মোমেনের পক্ষে চমক দেখান নেতাকর্মীদের কাছে ‘ফুল টাইম রাজনীতিবীদ’ হিসেবে পরিচিত আজাদ। তার এই ভূমিকা প্রশংসিত হয় দলের সর্বমহলে।
এর আগে আজাদ সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। নেতাকর্মীদের ধারণা তৃণমূল থেকে উঠে আসা আজাদ এবার সম্মেলনে পেতে পারেন তার সাংগঠনিক দক্ষতার পুরস্কার। আজাদ ছাড়াও মহানগরের সাধারণ সম্পাদক পদে আলোচিত হচ্ছে বর্তমান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল আনোয়ার আলাওর, অধ্যাপক জাকির হোসেন, বিজিত চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক এটিএম হাসান জেবুল ও শফিউল আলম নাদেল এবং বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক জগদীশ দাস।
সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদের বড় ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন নেতাকর্মীরা। বিগত সিটি নির্বাচনেও দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন তিনি। প্রার্থী হওয়ার লক্ষ্যে তিনি চষে বেড়ান পুরোনগরী। ক্লিন ইমেজের অধিকারী এই নেতা দলের বাইরে সাধারণ মানুষের মধ্যেও নিজের শক্ত অবস্থান তৈরি করে নেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দলীয় সিদ্ধান্তে সরে দাঁড়ান নির্বাচন থেকে। কাজ করেন দলীয় প্রার্থী কামরানের পক্ষে। তার এই ত্যাগ ও অবদানের ফলস্বরূপ সম্মেলনে পদোন্নতি মিলতে পারে আসাদের দলের মধ্যে চলছে এমন আলোচনা।
সিটি নির্বাচনে দুইবার পরাজিত হলেও থেমে থাকেননি কামরান। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত চষে বেড়িয়েছেন পুরো সিলেট বিভাগ। সম্প্রতি সিলেট বিভাগের বিভিন্ন উপজেলা সম্মেলনেও কামরানের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা আর কর্মতৎপরতার প্রতিদান স্বরূপ মহানগরের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সদস্য পদ থেকে পদোন্নতি পেয়ে তিনি আগামীতে প্রেসিডিয়ামে বা কেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ কোন পদে স্থান করে নিতে পারেন- নেতাকর্মীদের মাঝে এমন আলোচনা চলছে বেশ জোরেশোরে।
সম্মেলন ও কাউন্সিলের ব্যাপারে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ জানান, কাউন্সিলরদের ভোটে যদি কমিটি হয় এজন্যে আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। কেন্দ্র যে সিদ্ধান্ত দেবে-যে পদ্ধতিতে করবেন আমরা তা মেনে নেব। অতীতে দলের প্রধান আমাদের প্রিয় নেত্রী যে দায়িত্ব দিয়েছিলেন তা পালন করেছি। আগামীতেও যে দায়িত্ব দিবেন তার জন্যও প্রস্তুত আছি। দলের জন্যে কাজ করতে প্রস্তুত।
কেন্দ্রীয় সদস্য ও নগর সভাপতি বদর উদ্দিন আহমদ কামরান বলেন, দলের যে দায়িত্ব দেয়া হবে সেই দায়িত্ব মেনে নিয়েই কাজ করব। দলের জন্যে আমি সবসময়ই প্রস্তুত। পদ প্রত্যাশী হলেই যে পদ পাওয়া যাবে-তা কিন্তু নয়। আমাদের সভানেত্রী আমাদের ব্যাপারে ভালো জানেন। তিনি ভালো করে জানেন, কে কি দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। দলের জন্য যে কোন দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত উল্লেখ করে তিনি বলেন, সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দলকে আরো শক্তিশালী করাই হলো আমাদের লক্ষ্য। সম্মেলন সফলের জন্যে তিনি দলের সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীসহ সিলেটবাসীর সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ কামনা করেন।
সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন আগামী ৫ ডিসেম্বর সিলেটের ঐতিহাসিক আলীয়া মাদ্রাসা মাঠে অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এমপি।