এসবিএন ডেস্ক:
শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা সম্পর্কে আগে থেকেই জানা ছিল শরীফ রেজা মাহমুদের। তবে সে জানার পরিধি ছিল খুবই সীমিত। ‘কবির স্মারক সংরক্ষণের কাজ করতে গিয়ে আমি জেনেছি তাঁকে হত্যার করুণ কাহিনি। চোখের পানি মুছতে মুছতে জেনেছি ইতিহাসের আলোর বাইরে থাকা আরও অনেক তথ্য। আমি এখানে প্রতিনিয়ত ইতিহাসের সঙ্গে বসবাস করি।’ বলছিলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের স্বেচ্ছাসেবক শরীফ রেজা মাহমুদ। শরীফের মতো ২০ জনের একটি স্বেচ্ছাসেবক দল যুক্ত রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের স্মারক সংরক্ষণ, সংগৃহীত স্মারকের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, শ্রেণিবিন্যাস, পরিচিতি তৈরির মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজের সঙ্গে। এমন গৌরবের গল্প দলটির প্রতি সদস্যের। এই তরুণদের কেউ পড়ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে, কেউ পড়াশোনার পাট চুকিয়ে সদ্য যোগ দিয়েছেন চাকরিতে। ক্যাম্পাস, পড়াশোনা, অফিস কিংবা পারিবারিক কাজের ফাঁকে যুক্ত রয়েছেন চেতনার বাতিঘর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কাজের সঙ্গে।
৮ ডিসেম্বর আমরা হাজির হয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। আড্ডা হয় এই তরুণ দলের কয়েকজনের সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজনীন নাহার বলেন, ‘ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের সংঙ্গে কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় করানোর একটি অনুষ্ঠান “ইউথ লিভিং লিজেন্ড”। আমি এই কর্মসূচির সঙ্গে প্রথমে যুক্ত হই। তারপর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের বিভিন্ন আয়োজনে কাজ করি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। এখানে এলে নিজের ভেতরটা পরম পবিত্র মনে হয়। নিজের প্রশান্তির জন্যই আমি এখানে যুক্ত হয়েছি।’
নাজনীনের চোখে-মুখে যে প্রশান্তির পরশ তা যেন ছুঁয়ে যায় আমাদের আড্ডাতেও। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আঙিনায় বসে আমরা জানতে থাকি তাঁদের নানা অভিজ্ঞতার কথা। সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী মন্টু সরকার বলেন, ‘আমরা কেউ জাদুঘর বিদ্যায় অভিজ্ঞ ছিলাম না। প্রথমে আমাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেখানে শেখানো হয় স্মারক সংরক্ষণের দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন পদ্ধতি।’
তাঁর সঙ্গে যোগ করেন ইডেন মহিলা কলেজের সুফিয়া নাজনীন, ‘বিভিন্ন সময় বিদেশি প্রশিক্ষকদের নিয়ে আয়োজন করা হয় সেমিনার। এ ছাড়া আমাদের সব সময়ের প্রশিক্ষক আর্কাইভ বিভাগের প্রধান আমেনা খাতুন তো রয়েছেনই। কাজ করতে গিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা জেনেছি। শহীদের রক্তে ভেজা শার্ট আমাদের শিখিয়েছে বীরত্বগাথা।’
ডকুমেন্টেশনের কাজের পাশাপাশি তাঁরা যুক্ত থাকেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নিয়মিত কর্মসূচিগুলোতেও। মুক্তির উৎসব ও বিজয় উৎসবের মতো বড় আয়োজনে স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে কাজ করেন তাঁরা। স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মির্জা মাহমুদ আহমেদ বলেন, ‘আমরা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগুলো আগলে রাখছি। এই প্রক্রিয়াটিও আমি মনে করি মুক্তিযুদ্ধের অংশ। আর এসব কাজের পাশাপাশি তহবিল সংগ্রহ, জাদুঘরের সব স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের সঙ্গেই যুক্ত থাকি।’
দলটির নানা অভিজ্ঞতার গল্প শুনতে শুনতে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আঙিনায় সন্ধ্যা নেমে আসে। কিন্তু এ তরুণদের মনে যে চেতনার চেরাগ জ্বলে উঠেছে, তা ধরা দেয় সন্ধ্যা আলো হয়ে।
গৌরব করার মতো কিছু থাকা চাই
আমেনা খাতুন
প্রধান সমন্বয়ক, ডকুমেন্টেশন বিভাগ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
তরুণদের মুক্তিযুদ্ধের স্মারক সংগ্রহের কাজে কীভাবে যুক্ত করা যায়, সে প্রচেষ্টা আমাদের শুরু থেকেই ছিল। এ জন্য তরুণদের নিয়ে আমাদের বিভিন্ন কর্মসূচি রয়েছে। নতুন জাদুঘরের কাজ শুরু হলে ট্রাস্টিরা জাদুঘরের কাজে তরুণদের যুক্ত করার কথা বলেন। আর্কাইভ বা স্মারক সংরক্ষণের কাজটি যেহেতু স্পর্শকাতর। সে কাজে বিশ্বস্ত লোক দরকার। তাই যেসব স্বেচ্ছাসেবক জাদুঘরের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করছেন, তাঁদের মধ্য থেকে এই দলটিকে বেছে নিলাম। এই তরুণদের ডকুমেন্টেশনের ওপর প্রাথমিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে যুক্ত করা হয়। তাঁরা সবাই স্বেচ্ছাসেবক। পাঁচজন ছাড়া বাকিরা নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী জাদুঘরের কাজ করে চলেছেন। আমি মনে করি, ক্যারিয়ারের পাশাপাশি একজন মানুষের গৌরবের বিষয়টিও থাকা চাই। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তরুণদের মধ্যে এই বোধটি তৈরি করতে কাজ করছে।