সিলেট রেলওয়ে স্টেশনে কর্মরত গভর্নমেন্ট রেলওয়ে পুলিশ (জিআরপি)’র ওসি জাহাঙ্গীর হোসেনের বিরুদ্ধে আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি, বখরার বিনিময়ে স্টেশন এলাকায় মাদক বেচাকেনায় অবাধ সুযোগ প্রদান, স্টেশনের বাইরে-ভেতরে লাইসেন্সবিহীন অবৈধ টং দোকান বসিয়ে এবং ভাসমান হকারদের প্ল্যাটফরমে অবাধ বিচরণের সুযোগ দিয়ে বড় অংকের ফায়দা হাসিল এবং সর্বোপরি রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের প্রতি অসদাচরণের অভিযোগ উঠেছে।
বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নাম ভাঙ্গিয়ে আন্তঃনগর ট্রেনের টিকেট সংগ্রহের পর সেই টিকেট নিজের নিয়োগকৃত দালালদের মাধ্যমে বিক্রির অভিযোগ এখন ওসি’র বিরুদ্ধে নিত্যদিনের। সিলেট রেলস্টেশন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সুত্র জানিয়েছে, ওসি জাহাঙ্গীর তার বরাবরে টিকেট ইস্যুর জন্য জিআরপি ওসি’র অফিসিয়াল সিল-স্বাক্ষর ব্যবহার করে রিক্যুইজিশন স্লিপ পাঠিয়ে প্রায় প্রতিদিন-ই ২০/২৫টি করে টিকেট নিয়ে যান।
এই টিকেট বাণিজ্য নিয়ে রেল কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সাথে প্রায়ই তার খিটিমিটি লেগে আছে। কোন কোন ক্ষেত্রে পুলিশী কায়দায় রেল কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সাথে অসদাচরণের ঘটনাও ঘটছে। নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে অনেকের কাছে চাঁদা দাবি করেন বলে কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন। ওসি’র এসব অপকর্মে স্টেশনে কর্মরত রেল কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মধ্যে বিরাজ করছে ক্ষোভ।
রেলওয়ে স্টেশন সংশ্লিষ্ট একটি সুত্র জানায়, ওসি জাহাঙ্গীর হোসেন সিলেট জিআরপি থানায় যোগদানের পূর্বে বেশ কিছুদিন স্টেশন এলাকায় মাদক বেচাকেনা বা সেবনের ঘটনা প্রায় বন্ধ-ই ছিল। প্রায় ৩ বছর পূর্বে নতুন ওসি হিসেবে জাহাঙ্গীর হোসেন যোগ দেয়ার পর থেকে রেলস্টেশন এলাকায় শুরু হয় মাদকের ছড়াছড়ি।
বেপরোয়া ওসি রেল কর্মচারিদের উপর প্রভাব বিস্তারের অসৎ উদ্দেশ্যে পুলিশী কায়দায় তাদের সাথে দূর্ব্যবহার করে থাকেন। ওসি’র বিভিন্ন অপকর্ম উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবগত হয়ে তাকে ইতোমধ্যেই ২ বার বদলি করা হয়েছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ‘ম্যানেজ’ করে বদলির আদেশ ঠেকিয়ে বহাল তবিয়তে আছেন জিআরপি’র বর্তমান ওসি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেট রেলওয়ে স্টেশনের টিকেট বুকিং সেকশনের কম্পিউটার বিভাগে সিলেটের বিভাগীয়, জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের বিভিন্ন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার নাম ভাঙ্গিয়ে আন্তঃনগর ট্রেনের টিকেটের জন্য জিআরপি’র ওসি নিয়মিত রিক্যুইজিশন স্লিপ পাঠান। সুত্র জানিয়েছে, ওসি’র এভাবে টিকেট নেয়ার পরিমাণ প্রতিদিন কমপক্ষে ২০/২৫টি হবে। পরে সংগৃহিত টিকেটগুলো নিজের নিয়োগকৃত দালালদের মাধ্যমে কালোবাজারে চড়া দামে বিক্রি করা হয়।
এ ক্ষেত্রে তাকে সহযোগিতা করেন রেলওয়ের বুকিং সেকশনের কম্পিউটার নিয়ন্ত্রক জহির ও নিজাম। প্রতিনিয়ত এই দু’জন ওসি’র টিকেট বাণিজ্যের দোসর। তবে নিজামকেই ওসির সাথে বেশী ফুসুর-ফাসুর করতে দেখা যায়। আর বাইরে থেকে ওসিকে সহযোগিতা করে ভাসমান হকার নুরু। যার পুরো নুরুল ইসলাম। কুমিল্লার বাসিন্দা নুরু হকার রেলভবনে অবস্থিত প্রত্যাশা বোর্ডিং-এ রুম ভাড়া করে দেদারছে চালিয়ে যাচ্ছে টিকেট বাণিজ্য। প্রায় প্রকাশ্যে নুরু এসব অপকর্ম করলেও তাকে কেউ কিছু বলতে সাহসী হয় না ওসি’র শেল্টারে কারণে। জিআরপি ওসি’র এই দৌরাত্মে রেলওয়ে স্টেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারিরা অতীষ্ট।
জানা গেছে, রেলওয়ে স্টেশনের অভ্যন্তরে রুজেশ ফাস্ট ফুডের মালিক জনৈক কবির এবং এলাহী ফাস্ট ফুডের মালিক জনৈক আলমগীর অনেকটা প্রকাশ্যেই টিকেট কালোবাজারিতে লিপ্ত। জিআরপি ওসিকে প্রতি মাসে জনপ্রতি ১০ হাজার টাকা করে মাসোহারা দিয়ে ওরা টিকেট বাণিজ্য অব্যাহত রেখেছে। কবির ও আলমগীরের সাথে ঘনিষ্ট অপর একটি সুত্র জানিয়েছে, টিকেট কালোবাজারি করে ভিন্ন জেলার বাসিন্দা আলমগীর ইতোমধ্যেই স্থানীয় লাউয়াই এলাকায় প্রায় কোটি টাকা মূল্যের বাড়ির জমি কিনেছে।
অনুরূপ কবিরও সিলেটে নিজস্ব বাড়ি তৈরীর পাশাপাশি ট্রাকসহ কয়েকটি গাড়ির মালিক হয়েছে। এমনিভাবে রেলওয়ে স্টেশন ভবনের পূর্বপাশে গাড়ি পার্কিং প্লেসে জিআরপি ওসি দু’টি টং দোকান বসিয়ে ফায়দা লুটছেন। টং দোকানে চা-সিগারেটের আড়ালে ইয়াবাসহ বিক্রি হয় নানারকমের মাদকদ্রব্য। এজন্য টং দোকানদাররা জনপ্রতি প্রতিদিন ওসিকে ১শ’ টাকা করে বখরা দেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জিআরপি’র সিলেট থানায় বর্তমান ওসি যোগদানের পূর্বে বেশ কিছুদিন স্টেশন এলাকায় প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি বন্ধ ছিল। কিন্তু বর্তমান ওসি দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে বখরার সুবাদে আবারও প্রকাশ্যে মাদক বেচাকেনা শুরু হয়েছে। ভ্রাম্যমান মাদক বিক্রেতারা পুলিশী শেল্টারে স্টেশন এলাকায় প্রায় জনসমক্ষেই বিক্রি করছে রকমারি মাদক। এদের সাথে সাথে মাদকসেবীরাও হয়ে উঠেছে বেপরোয়া। অনেকটা প্রকাশ্যে ওরা সেবন করছে মাদকদ্রব্য।
সুত্র দাবি করেছে, এসব অপকর্মের সুযোগ দিয়ে জিআরপি’র ওসি মাসে কমপক্ষে ২ লাখ টাকার ফায়দা হাসিল করছেন। এখানেই শেষ নয়, প্রতিদিন প্রত্যেকটি আন্তঃনগর ট্রেন আসা-যাওয়ার সময় সিলেট রেলস্টেশনে বিপুলসংখ্যক ভাসমান হকারের দৌরাত্মে যাত্রী সাধারণ অতীষ্ট। আর এসব হকার প্রতিদিন জিআরপি’র ওসিকে জনপ্রতি ৫০ টাকা হারে বখরা দিয়ে রেলস্টেশনের প্লাটফরম এবং প্রতিটি ট্রেনে অবাধে ব্যবসা করছে, যা ব্যবসায়িকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করছে বাংলাদেশ রেলওয়েকে।
জিআরপি ওসি’র পক্ষে ক্লিনার সুপারভাইজার শহীদ ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব পালন করছেন। প্রতিটি টং দোকান, ভাসমান হকার এবং টিকেট কালোবাজারিতে লিপ্ত দালালদের কাছ থেকে প্রতিদিন ওসি’র বখরা আদায় করেন ওই শহীদ ক্লিনার। আর বিনিময়ে শহীদ পান নিয়মিত মাসোহারা। এভাবে জিআরপি ওসি’র দৌরাত্ম আর অপকর্মে কলুষিত হচ্ছে সিলেট রেলওয়ে স্টেশনের পরিবেশ। দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে যাত্রী সাধারণকে।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে জিআরপি ওসি জাহাঙ্গীর হোসেনকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘আমাকে জিজ্ঞেস করলে তো আমি অবশ্যই অভিযোগ অস্বীকার করবো। আপনারা ইনভেস্টিগেশন করে দেখেন, সত্য না মিথ্যা।’ তিনি বলেন, ‘ভিআইপিদের নামে টিকেট নেয়ার কোন সুযোগ নেই।’ তবে প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নামে টিকেট সংগ্রহের বিষয় সত্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ফোন করলেই জানতে পারবেন, তাদের জন্য টিকেট নেয়া হয়েছে কি না।
’ তিনি বলেন, রুজেশ ফাস্ট ফুডের মালিক কবির এবং এলাহী ফাস্ট ফুডের মালিক আলমগীর টিকেট কালোবাজারি করে। গত দু’বছরে আমি কবিরকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে জেলে পাঠিয়েছি। কিন্তু পরবর্তীতে আদালত থেকে জামিন নিয়ে এসে সে আড়ালে-আবডালে অপকর্ম করতে পারে।’ পার্কিং প্লেসে টং দোকান সম্পর্কে কোন উত্তর দেননি ওসি। তবে মাদক বিক্রি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আপনারা খোজ নিয়ে দেখেন মাদক কোথায় বিক্রি হচ্ছে? কারণ পুরো স্টেশন এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতাভূক্ত।
তাই কে কোথায় কোন অন্যায় করছে, তা অনায়াসে ধরা পড়বে।’ হকারদের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘যাত্রীর ছদ্মবেশে অনেক হকার ট্রেনে উঠে পড়লে, আমরা তাদের তাড়িয়ে দেই। এদের কাছ থেকে বখরা নেয়ার প্রশ্নই উঠে না। আপনারা হকারদের জিজ্ঞেস করলেই এর সত্যতা পেয়ে যাবেন।’ রেলওয়ের বুকিং সেকশনের কম্পিউটার নিয়ন্ত্রক জহির নিজের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমি একজন সাধারণ কর্মচারি মাত্র। কেউ হয়তো হিংসার বশবর্তী হয়ে আমার বিরুদ্ধে এসব রটনা করছে।’