সিলেটের দক্ষিণ সুরমার রশিদপুরে সিলেটগামী লন্ডন এক্সপ্রেস ও ঢাকাগামী এনা পরিবহনের মুখোমুখি সংঘর্ষে এক চিকিৎসকসহ ৮ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে এনা পরিবহনের চালক, সুপারভাইজার, হেলপার এবং লন্ডন এক্সপ্রেসের চালকও রয়েছেন। গতকাল শুক্রবার সকাল পৌনে ৭টায় রশিদপুর রহমান ফিলিং স্টেশনের সামনের কালভার্টে ভয়াবহ এই দুর্ঘটনাটি ঘটে। দুর্ঘটনায় ২০ জন আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে গুরুতর অবস্থায় ১৭ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন গিয়ে বাস দু’টি কেটে হতাহতদের উদ্ধার করে। ঘটনার পর ২ ঘণ্টারও বেশি সময় সিলেট-ঢাকা মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকে। দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, সকালে তেমন কুয়াশা ছিল না। গাড়ির অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে লন্ডন এক্সপ্রেস দ্রুতগতিতে ওভারটেক করতে গিয়েই এনার সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ৮ জন মারা যান। পুরো বিষয়টির তদন্তে বিস্তারিত বেরিয়ে আসবে।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, রশিদপুর রহমান ফিলিং স্টেশনের সামনের কালভার্টে গতকাল সকাল পৌনে ৭ টায় বাস দুটির বিকট শব্দে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এ সময় হতাহতদের আর্তচিৎকারে সেখানকার পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। দুর্ঘটনায় এনা পরিবহনের যাত্রী নগরের উইমেন্স মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক ও ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ডাঃ আমজাদ খানের পুত্র ডাঃ অলি মাহমুদ ইমরান খান রুমেল (৪৫), এনা পরিবহনের চালক ওসমানীনগর উপজেলার দরকা গ্রামের মানিক মিয়ার পুত্র মঞ্জুর আলী (৪০), সুপারভাইজার জগন্নাথপুরের মিঠাভরাং গ্রামের অলিউর রহমান খানের পুত্র সালমান আহমদ খান (৩০), হেলপার ওসমানীনগরের দরকা গ্রামের মৃত মনসুর আলীর পুত্র জাহাঙ্গীর হোসেন (২৫), লন্ডন এক্সপ্রেসের চালক ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার রাজবাড়িয়াকান্দির (শাহবাজপুর) আলী হায়দারের পুত্র নুরুল আমিন (৫০), লন্ডন এক্সপ্রেসের যাত্রী ঢাকার ওয়ারীর বাসিন্দা কলেজ ছাত্র নাদিম হোসেন সাগর (১৯), এনা পরিবহনের যাত্রী সিলেট নগরের আখালিয়া নতুন বাজারের শাহ কামাল (৪৫) ও দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলা বাজারের রহিমা বেগম (৩০) নিহত হন। পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্র জানায়, ওসমানী হাসপাতালের আইসিইউতে দুপুর সাড়ে ১২টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় রহিমা বেগম মারা যান। বাকি ৭ জন ঘটনাস্থলেই মারা যান।
প্রত্যক্ষদর্শী রহমান ফিলিং স্টেশনের কর্মচারী নয়ন চন্দ্র জানান, তিনি ফিলিং স্টেশনে দাঁড়িয়েছিলেন। হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পান। সামনে তাকিয়ে দেখেন, বাস দুটি মুখোমুখি সংঘর্ষে একটির ভেতর আরেকটি ঢুকে পড়েছে। এনা পরিবহনের ভেতরে ঢুকে গেছে লন্ডন এক্সপ্রেস। ঘটনার ১০-১৫ মিনিট পর পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ছুটে আসেন। ঘটনার পর কয়েকজন যাত্রী বাস দুটির জানালার কাঁচ ভেঙে বের হন বলে জানান তিনি।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্র জানায়, ঘটনার পর পরই পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ঘটনাস্থলেই ছুটে যান। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা বাস দুটির সামনের অংশ কেটে আলাদা করে রক্তাক্ত অবস্থায় হতাহতদের বের করে নিয়ে আসেন। এসময় বাস দুটির চালকসহ হতাহতদের দ্রুত ওসমানী হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক ৭ জনকে মৃত ঘোষণা করেন। আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
আহতরা হলেন, নিহত ডাক্তার ইমরান খান রুমেলের স্ত্রী ডাঃ শারমীন আক্তার অন্তরা (২৯), শেখ মোহাম্মদ রুহেল আহমদ (৩০), শাহ মোঃ নেওয়াজ, নিহত কলেজ ছাত্র সাগরের সহোদর ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডাঃ জাহেদ হাসান (৩৫), তার মা চান বিবি (৭০), বোন শারমীন (৩০), সীমা পারভীন (৩০), সেলিনা পারভীন (৩০) ও ভাগনা মাহি (৭), লন্ডন এক্সপ্রেসের সুপারভাইজার শামীম মিয়া (২৩), যাত্রী রেজাউল করিম (৫০), জসিম উদ্দিন (৩০), আলা উদ্দিন (৬০), মায়ান (১৬), সালাম (৪০), সানাত (৩৫) ও সুবর্ণা (৩০)।
জানা যায়, রাজধানী ঢাকার আরামবাগ থেকে লন্ডন এক্সপ্রেসের (ঢাকা-মেট্রো-ব-১৫-৩১৭৬) বাসটি ২৮ জন যাত্রী নিয়ে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১১টায় বাসটি নিয়ে রওয়ানা হন চালক নুরুল আমিন । এনা পরিবহনের বাসটি গতকাল শুক্রবার ভোর সাড়ে ৬টায় ৮ জন যাত্রী নিয়ে কদমতলী নিজস্ব টার্মিনাল থেকে রাজধানী মহাখালীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়।
সকাল পৌনে সাতটায় দুটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষের পর সিলেট-ঢাকা মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দুদিকে আটকা পড়ে শত শত যানবাহন। খবর পেয়ে ঘটনার পরই দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি মনিরুল ইসলাম, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক কোবাদ আলী সরকার ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তারা উদ্ধার প্রক্রিয়া পুরোটাই পরিচালনা করেন। অনেক চেষ্টার পর সকাল সাড়ে ৯টার পরে যান চলাচল শুরুর ব্যবস্থা করে দেয় পুলিশ। সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার পরিতোষ ঘোষ, উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) ফয়সল মাহমুদ, দক্ষিণ সুরমা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল হক, পরিবহন শ্রমিক নেতৃবৃন্দ ঘটনাস্থলে ছুটে যান। যান চলাচল চালু করতে শ্রমিক নেতৃবৃন্দ পুলিশকে সহযোগিতা করেন।
সকাল ৯টায় সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, দুর্ঘটনার স্থান রক্তে লাল হয়ে আছে। বাস দুটির সামনের অংশ পড়ে রয়েছে বিধ্বস্ত অবস্থায়। এনা পরিবহনের বাসটি রেকার দিয়ে রহমান ফিলিং স্টেশনের সামনে নিয়ে রাখা হয়। কিন্তু অটোলক থাকায় লন্ডন এক্সপ্রেসের বাসটি তাৎক্ষণিক সরানো সম্ভব হয়নি। এনা পরিবহনের চালকের স্টিয়ারিং মাটিতে গিয়ে পড়েছে। বাসের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে যাত্রীদের জুতো। এ সময় শত শত উৎসুক লোকজনকে ঘটনাস্থলে ভিড় করতে দেখা যায়।
লন্ডন এক্সপ্রেসের চালকের বেপরোয়া ড্রাইভিংয়ের কারণেই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে বলে বিভিন্ন সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। ওই গাড়ির যাত্রী জাহিদ হোসেন রাজ বলেন, শুরু থেকেই বাসটির চালক বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। ঘটনার সময় চালক ওভারটেকিং করার চেষ্টাকালেই চোখের সামনে মুহূর্তে ঘটনাটি ঘটে গেল। লন্ডন এক্সপ্রেসের বেঁচে যাওয়া হেলপার সাকিব মিয়া নিজেও সিলেটের ডাককে এর সত্যতা নিশ্চিত করেন। ঘটনার পর হেলপার সাকিব কদমতলীস্থ তাদের প্রধান অফিসে চলে আসে। দুপুর ১২টায় প্রধান অফিসে গিয়ে দেখা যায়, কোন লোকজন নেই। ভেতরেও নীরব-নিস্তব্ধ। হাঁক দিলে একজন দাঁড়িয়ে নিজেকে সহকারী ম্যানেজার মুহিবুর রহমান নকীব বলে পরিচয় দেন। কথাবার্তার এক সময় দুর্ঘটনা কবলিত বাসের হেলপার সাকিব তার পরিচয় দেন। অফিসের এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে শুয়েছিলেন সাকিব। এক পর্যায়ে সাকিব নিজের পরিচয় প্রকাশ করে ঘটনার পুরো বর্ণনা দেন।
হেলপার সাকিবের বর্ণনা অনুযায়ী, ‘ঢাকা থেকে রওয়ানার পর ভালোভাবেই আমরা গন্তব্যে যাচ্ছিলাম। রশিদপুরে পৌঁছার পর মিতালী পরিবহনের একটি বাস সামনে আসে। মিতালীর বাসটিকে ওভারটেক করার চেষ্টা করছিলেন চালক নুরুল আমিন। মিতালীকে ওভারটেক করতে আমাদের চালক টান দিলেই এনার মুখোমুখি হয়ে ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়ে যায়। চোখের সামনেই প্রাণ হারাতে দেখলাম অনেক দিনের পরিচিত চালক নুরুল আমিনকে। সুপারভাইজারও আহত হলেন। এসময় বাসের ভেতরে আহাজারি চলতে থাকে। আল্লাহর দয়ায় বেঁচে গেলাম বলে জানান ঢাকার মানিকনগরের বাসিন্দা সাকিব। ঘটনার পর পরই সাকিব বাস থেকে নেমে কদমতলী অফিসে চলে যান বলে জানান। এরপরে ঢাকার অফিসে ঘটনাটি জানান। সাকিব জানান, আমাদের চালকের ওভারটেকের কারণেই এই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে।
এদিকে লন্ডন এক্সপ্রেসের সিলেটের ম্যানেজার ইসলাম উদ্দিন জানান, আমাদের চালক ও একজন যাত্রী মারা গেছেন। বাকিরা আহত হয়েছেন।
এনা পরিবহনের এক দায়িত্বশীল বীর মুক্তিযোদ্ধা সেলিম আহমদ ফলিক জানান, আমাদের চালক, সুপারভাইজার, হেলপার ও ৩ যাত্রীসহ ৬ জন নিহত হয়েছেন। বাকি যাত্রীদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। লন্ডন এক্সপ্রেসের চালকের বেপরোয়া ড্রাইভিংয়ের কারণেই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
দুপুরে ওসমানী হাসপাতালের মর্গে গিয়ে দেখা যায়, নিহতদেরকে পুলিশের ব্যাগে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে। মর্গের বাইরে স্বজনরা কান্নাকাটি করছেন। বিশেষ করে ডাক্তার ইমরানের পিতা বয়োবৃদ্ধ প্রফেসর ডাঃ আমজাদ খানও পুত্রশোকে কাতর হয়ে পড়েন। তাকে সান্ত¦না দিচ্ছেন সহকারী ডাক্তাররা। মর্গের সামনেও উৎসুক লোকদের ভিড় ছিল লক্ষণীয়। দুপুর সাড়ে ১২টায় মারা যান রহিমা বেগম। কিন্তু প্রথমে তার কোন পরিচয় পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে সাথে থাকা মোবাইল ফোনের ডায়ালের নম্বরে কল দেন এক নার্স। এর পরই তার পরিচয় শনাক্ত হয়। বিকেলে সুরতহাল প্রতিবেদনের পর স্বজনদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়াই নিহতদের লাশ তাদের নিকট হস্তান্তর করা হয়। ওসমানী হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এস, আই জয়নাল জানান, আহতদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সিলেটের উপ-পরিচালক কোবাদ আলী সরকার জানান, লন্ডন এক্সপ্রেসের চালকের কারণেই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে। তদন্তে দুর্ঘটনার আসল কারণ বেরিয়ে আসবে।
এদিকে, মহাসড়কে এমন ভয়াবহ ঘটনার পরও গতকাল শুক্রবার দিনভর হাইওয়ে পুলিশের কাউকে দেখা যায়নি। নগর পুলিশের সদস্যরাই ঘটনার পরে ব্যস্ত ছিলেন।
সিলেট মহানগর পুলিশ কমিশনার নিশারুল আরিফ গতরাত ৯টায় বলেন, দুর্ঘটনায় দুই বাসের দুই চালকই নিহত হয়েছেন। তবুও মামলা দায়ের হবে। নিহতদের কোন স্বজন মামলা করলে মামলা রেকর্ড হবে । না হয় পুলিশের পক্ষ থেকে মামলা দায়ের করা হবে।

:সিলেটের ডাক: