গতকাল মঙ্গলবার শেরে বাংলানগরের এনইসি সভায় চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সভাশেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী এনইসি সভায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
এনইসি সভাশেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, পরিকল্পনা বিভাগের সদস্য জ্যেষ্ঠ সচিব আসাদুল ইসলাম ও পরিকল্পনা কশিমনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (জ্যেষ্ঠ সচিব) ড. শামসুল আলম এসব তথ্য তুলে ধরেন। তারা জানান, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রয়োজন হবে মোট ৬৪ হাজার ৯৫৯ দশমিক আট বিলিয়ন টাকা। যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আসবে ৮৮ দশমিক পাঁচ শতাংশ এবং বিদেশি উৎসহ থেকে আসবে ১১ দশমিক পাঁচ শতাংশ। মোট বিনিয়োগের মধ্যে সরকারি খাত থেকে আসবে ১২ হাজার ৩০১ দশমিক দুই বিলিয়ন টাকা, যার আকার ১৮ দশমিক নয় শতাংশ। আর বেসরকারি খাত থেকে আসবে ৫২ হাজার ৬৫৮ দশমিক ছয় বিলিয়ন টাকা, যার আকার ৮১ দশমিক এক শতাংশ।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় প্রত্যেক নাগরিকের অংশগ্রহণ এবং তা থেকে উপকৃত হওয়া এবং দরিদ্র ও দুর্দশাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সহায়তা দেওয়ার লক্ষে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক কৌশল নেওয়া হয়েছে। টেকসই উন্নয়নের জন্য পথপরিক্রমা প্রণয়ন, যা হবে দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন সহনশীল ও টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ করা। ২০৩১ সাল নাগাদ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে নতুন পরিকল্পনায়।
তিনি বলেন, এক কোটি ১৬ লাখ ৭০ হাজার কর্মসংস্থানের বিশাল লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে নিয়ে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে অষ্টম (২০২১-২৫) পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। এর মধ্যে ৩৫ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে প্রবাসে বাকি ৮১ লাখ ৭০ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে দেশে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় গত পাঁচ বছরে (২০১৬-২০) মোট কর্মসংস্থানের লক্ষ্য ছিল এক কোটি ২৯ লাখ। এর মধ্যে দেশীয় এক কোটি নয় লাখ ও বিদেশি ২০ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্য ছিল। এর মধ্যে কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে ৯৫ লাখ। এর মধ্যে দেশে ৬০ লাখ ও প্রবাসে ৩৫ লাখ। কোভিড-১৯ এর অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে এবার এনইসি সভায় উঠছে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। পরিকল্পনায় কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় পিছিয়ে পড়া জেলাগুলো থেকে বিদেশে কর্মী পাঠানোর সুযোগ তৈরির লক্ষ্যে সঠিক তথ্য, প্রশিক্ষণ, অভিবাসন ব্যয় মেটাতে ঋণ সহায়তা দেওয়া হবে। ২০২১ সালে ২১ লাখ ৬০ হাজার, ২০২২ সালে ২২ লাখ ৩০ হাজার, ২৩ সালে ২৩ লাখ ৩০, ২৪ সালে ২৪ লাখ ২০ এবং ২০২৫ সালে ২৫ লাখ ৩০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে সরকার।
গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকার মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল আট দশমিক ২০ শতাংশ। বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯) ধাক্কায় সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। ওই অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে পাঁচ দশমিক ২৪ শতাংশ। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হচ্ছে আট দশমিক ৫১ শতাংশ।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে আট দশমিক ৫১ শতাংশ। এই ধারাবাহিকতায় ২০২১ অর্থবছরে আট দশমিক ২০, ২০২২ অর্থবছরে আট দশমিক ২২, ২০২৩ অর্থবছরে আট দশমিক ২৯, ২০২৪ অর্থবছরে আট দশমিক ৩২, ২০২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার আট দশমিক ৫১ শতাংশ ধরে অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে সার্বিক মূল্যস্ফীতির লক্ষ ধরা হয়েছে পাঁচ দশমিক পাঁচ শতাংশ। আগামী ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে পাঁচ দশমিক চার শতাংশ, পাঁচ দশমিক তিন শতাংশ, পাঁচ দশমিক দুই শতাংশ, চার দশমিক নয় শতাংশ এবং সবশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি নেমে আসবে চার দশমিক আট শতাংশে।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, আমাদের মতো একটা উন্নয়নশীল দেশের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূর করা। দারিদ্র্যের হার কমানো বাংলাদেশের অন্যতম বড় সাফল্য হিসেবে সারাবিশ্বেই সমাদৃত। তারপরও বাংলাদেশের ২০ শতাংশ মানুষ এখনো দরিদ্র যা সংখ্যায় তিন কোটিরও বেশি। ২০১৯ সালের সরকারি হিসেবে দারিদ্র্য হার ২০.৫ এবং হতদরিদ্রের হার ১০.৫। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক মেয়াদান্তে দারিদ্র্যের হার ১৫.৬ শতাংশে ও অতি দারিদ্র্যের হার ৭.৪ শতাংশে দাঁড়াবে বলে পরিকল্পনা করা হয়েছে।
এদিকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু ধারাবাহিকভাবেই বাড়ছে। শিশুমৃত্যুর হার কমে আসায় এবং দেশে জটিল রোগের চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধি পাওয়াকে এর অন্যতম কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বর্তমানে গড় আয়ু ৭২ দশমিক ছয় বছর। এর মধ্যে পুরুষ ৭১ দশমিক এক, নারী ৭৪ দশমিক দুই বছর, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক মেয়াদান্তে প্রত্যাশিত গড় আয়ু হবে ৭৪ বছর।
এছাড়া অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে দারিদ্র্য মোকাবিলায় কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। পিছিয়ে পড়া জেলাগুলোতে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচিকে উচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া এবং সুবিধাভোগীদের সংখ্যা বাড়ানো হবে। এসব জেলাগুলোতে কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং আয় বৃদ্ধির জন্য কৃষি গবেষণা ও সম্প্রসারণ সেবার ওপর অধিকতর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আগামী পাঁচ বছরে নতুন এক কোটি ১৬ লাখ কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হচ্ছে। তবে কর্মসংস্থানের এই লক্ষ্য সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার তুলনায় ১০ লাখ কম। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অনেক লক্ষ্যই পূরণ হয়নি। যেটা অষ্টম পঞ্চমবার্ষিকী পরিকল্পনার মধ্যে ঠাঁই পেয়েছে। এনএমএস।