সিলেট:: মহামারি করোনাকালে ঘরবন্দী শিশুদের মধ্যে মোবাইল ফোন এবং ট্যাব ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। অনেক অভিবাবকও খেলাচ্ছলেই শিশুদের হাতে মোবাইল তুলে দিচ্ছেন। অবাধ মোবাইল ব্যবহার তাদেরকে জটিল রোগের ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে বলে অভিমত চিকিৎসকদের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বয়স্কদের চেয়ে শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। তাদের মস্কিষ্কের গঠন নরম। ফলে মোবাইল ফোন তাদের কোমল জীবন হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে। তারা বলছেন, করোনার শুরু অর্থাৎ গত ২৫ মার্চ থেকে শিশুদের স্কুল বন্ধ। এখন প্রত্যেক শিশু তাদের মা বাবাকে যথেষ্ট সময় কাছে পাচ্ছে। এই সময় শিশুদের মোবাইলের পরিবর্তে তাদের হাতে বই তুলে দেয়া উচিত অভিভাবকদের।
পাশাপাশি তাদেরকে মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে পারেন। যেটি শিশুর সারাজীবন কাজে লাগবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিলেটের সহকারি পরিচালক ডা. আনিসুর রহমান জানান, ‘নিয়মিত মোবাইল ব্যবহার শিশুর বিকাশের পথে বড় বাধা। তারা পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়ে যায়। তিনি বলেন, আগে শিশু খেতে না চাইলে রঙিন বইয়ের বর্ণমালা আর ছবি দেখিয়ে খাওয়ানো হতো। এখন মোবাইল ফোন দিয়ে খাওয়ানো হয়। এমন শিশুদের ভবিষ্যতে চোখসহ নানা ধরণের সমস্যায় পড়তে হবে।’
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সহকারী অধ্যাপক ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আখলাক আহমদ বলেন, অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারের ফলে তাদের মধ্যে এক ধরণের আসক্তি তৈরী হয়ে যায়। তখন বয়সের সাথে উপযোগী নয়, এমন ধরণের বিষয়ের সাথে তারা সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। এজন্য সবচেয়ে বেশী সচেতন হতে হবে অভিভাবকদের।’
করোনা ভাইরাসের শুরু থেকে সারা দেশের মতো সিলেটের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে।
দীর্ঘ এই ছুটিতে শিশুরা ঘরবন্দী হয়ে পড়ে। বন্ধ হয়ে যায় তাদের বাইরের পৃথিবীর সকল দরজা। তখন ঘরে থাকা সেই শিশুদের আনন্দ বিনোদনের মাধ্যম হয়ে পড়ে মোবাইল। ঘন্টার পর ঘন্টা তারা মোবাইলের মধ্যে ডুবে থাকে। অনেক অভিভাবকও কার্টুন, ভিডিও গেম খেলার জন্য বাচ্চার হাতে স্মার্ট ফোন তুলে দিচ্ছেন। বাচ্চারা যাতে ছোটাছুটি না করে এক জায়গায় শান্ত হয়ে বসে থাকে; এজন্য অভিভাবকরা এই পদ্ধতি অবলম্বন করছেন। ট্যাব বা মোবাইল পাবার পর শিশুদের নিত্য সঙ্গী হয়ে যাচ্ছে এ দুটি জিনিস। অধিকাংশ শিশু মোবাইল ছাড়া খেতে চায় না, ঘুমুতে যায় না। সবকিছু ভুলে তারা সারাক্ষণ মোবাইলে গান শুনে, কার্টুন দেখে সময় পার করছে। মোবাইল হাতে দেয়ার পর অনেক শিশু বিভিন্ন প্রোগ্রাম সম্পর্কেও পাকা হয়ে যাচ্ছে। তারা নিজেরা অনেক গেইমস. অ্যাপস ডাউনলোড করতে পারে। যা অনেক অভিভাবকের পক্ষেও সম্ভব হয় না। সন্তানের এমন কর্মকান্ডকে অনেক অভিভাবক উৎসাহ দেন। তারা আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন। এতে শিশুর সর্বনাশের মাত্রা আরো কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাক কান গলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও হেড-নেক বিশেষজ্ঞ লেজার সার্জন ডা. নূরুল হুদা নাঈম বলেন, ‘শিশুদের হাতে মোবাইল বা ট্যাব দেয়া উচিত নয়। এতে নানা ধরনের রোগের জন্ম হয় শিশুদের শরীরে। মোবাইল ফোন থেকে নির্গত রশ্মি শিশুদের দৃষ্টিশক্তির ভীষণ ক্ষতি করে। যেসব শিশু দৈনিক পাঁচ-ছয় ঘন্টা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে খুব অল্প বয়সে তারা চোখের সমস্যায় ভুগে। অনেকে ঘাড় বাকা করে কথা বলে। শিশু বয়সে সমস্যা না হলেও বড় হবার পর তার মাশুল দিতে হবে। তিনি বলেন, মোবাইলের পরিবর্তে তাদের হাতে বই দেওয়া উচিত। ঘরের মধ্যে পর্যাপ্ত খেলাধুলার সুযোগ করে দেওয়া উচিত। বাজারে অনেক ধরণের খেলনা পাওয়া যায়।’
মাছুদিঘীর পার এলাকার বাসিন্দা জাফর খানের তিন সন্তান। দুই মেয়ে স্কুলে পড়ছে। ছোট মেয়ের বয়স তিন বছর। তিনি বলেন, মোবাইল হাতে না দিলে ছোট মেয়েটিও খেতে চায় না। এমনকি ঘুমও পাড়াতে হয় মোবাইল হাতে দিয়ে। অন্যদিকে অনলাইনে ক্লাস শুরুব পর থেকে বড়রাও মোবাইল নির্ভর হয়ে পড়েছে। ক্লাসের সময় ঘন্টার পর ঘন্টা মোবাইলের সামনে বসে থাকতে হয়। লালাদীঘির পার এলাকার বাসিন্দা আশরাফুল কবীর লিমন বলেন, ‘মোবাইল শিশুদের জন্য নিরব ঘাতক। সবজেনেও আমরা আমাদের সন্তানকে মোবাইল ব্যবহার করতে দিচ্ছি। কারণ এখন ক্লাস করতে হচ্ছে মোবাইলে। সহপাঠীদের সাথে যোগাযোগও হচ্ছে এই মোবাইলে। এখন আমরা কোনদিকে যাবো।’
সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজী বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘মোবাইলের বেশী ব্যবহার বড়দেরও ক্ষতি করছে। সেই জায়গায় শিশুদের ক্ষতির পরিমাণ বেশী। যে শিশুরা মোবাইল না দিলে খেতে চায় না, পড়তে চায় না-তাদের ঘুম কম হবে। সেই শিশুদের মেজাজ সবসময় কিটকিটে থাকবে, পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। এজন্য বেশী সতর্ক থাকতে হবে মায়েদের।’
যোগাযোগ করা হলে বিশিষ্ট আইনজীবী ই ইউ শহিদুল ইসলাম বলেন, প্রযুক্তির ইতিবাচক দিকের পাশাপাশি নেতিবাচক দিকও আছে। শিশুদের মধ্যে প্রযুক্তির অপব্যবহারের অপপ্রয়োগ বাড়লে, তারা আসক্ত হয়ে পড়বে। আর সেই প্রভাব পরিবারের মতো সমাজের উপরও পড়বে। তিনি বলেন, অনলাইনে ক্লাস চললেও সেই ক্লাস বই নির্ভর হলে শিশুদের জন্য মঙ্গল। খেলাচ্ছলেই শিশুদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দিচ্ছেন বাবা মা-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি তাদের অজ্ঞতা। মা বাবার একটু অসাবধানতার কারণে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হতে পারে।’
সিলেট এম.সি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর সালেহ আহমদ বলেন, ‘শিশুরা যে হারে মোবাইল ব্যবহার করছে, বিদ্যালয় খোলার পর তারা সহজে পাঠ্যবইয়ে মন বসাতে পারবে না। তিনি বলেন, অনলাইনে কিছু সময় ক্লাস করলেও অধিকাংশ সময় তারা ব্যয় করছে অন্য কিছু দেখে। এজন্য অভিভাবকদের কঠোর না হয়ে বন্ধু হয়ে বুঝাতে হবে।’
যোগাযোগ করা হলে ড. সাদিকুর রহমান বলেন, অনেক অভিভাবক শিশুদের সময় দিতে পারেন না। করোনা অভিভাবকদের সেই সুযোগ করে দিয়েছে। তাই, অভিভাবকদের উচিত, শিশুদের প্রতি বেশী মনোযোগী হওয়া। একটি গবেষণার আলোকপাত করে তিনি বলেন, শিশুরা এক মিনিট মোবাইলে কথা বললে মস্তিষ্কে যে কম্পন সৃষ্টি হয় তা স্থির হতে সময় লাগে দুই ঘন্টা। যেসব বাচ্চা দৈনিক পাঁচ-ছয় ঘন্টা মোবাইল ব্যবহার করে তাদের বুদ্ধির বিকাশ সাধারণ বাচ্চাদের চেয়ে কম হয় বলে জানান তিনি।