সিলেট:: সিলেটের গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে চোরাই পথে ভারত থেকে অবাধে আসছে ভারতীয় গরুসহ বিভিন্ন অবৈধ পণ্য। অবৈধ পথে শুল্ক না দিয়ে প্রতি মাসে কয়েক’শ কোটি টাকার মালামাল আসছে। প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রকাশ্যেই চলছে রমরমা চোরাই পণ্য বাণিজ্য। সীমান্ত এলাকার স্থানীয় লোকজন বলছেন, কথিত কঠোর নিরাপত্তার মধ্যেও থেমে নেই সীমান্তের চোরাচালান। সীমান্ত এলাকায় চোরাচালানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিশাল সিন্ডিকেট। এই চোরাচালান চক্রকে স্থানীয়ভাবে লাগেজ পার্টি বলা হয়।
সরেজমিনে স্থানীয়দের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, ভারত থেকে প্রতিদিন শত শত গরু, বিভিন্ন ধরনের মদ, গাঁজা, ইয়াবা, বিড়ি, সিগারেট, ফেনসিডিল, ভারতীয় শাড়ি, থ্রি-পিস, কসমেটিকস, মসলাসহ ভারতীয় পণ্য আসছে। ভারতীয় এসব চোরাই পণ্যের দখলে চলে গেছে গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জের সীমান্তবর্তী হাটবাজার। বলা চলে অনেকটা অরক্ষিত হয়ে পড়ছে দুই উপজেলার সীমান্ত এলাকা। কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাটের সীমান্ত এলাকা দিয়ে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের পর ভারতীয় পণ্য ও গরুগুলো পিকআপ ভ্যানের সাহায্যে গোয়াইনঘাটের ভেতর দিয়ে চালান করা হয়। গোয়াইনঘাট থানা সদর হয়ে অবৈধ পণ্য ও গরু পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে হাতিরপাড়া-ফতেহপুর ও লাফনাউট-বাঘের সড়ক রোড। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই এই রোড দিয়ে শুরু হয় ভারতীয় অবৈধ সব পণ্য চোরাচালান। গোয়াইনঘাট হয়ে মালামালগুলো ছড়িয়ে পড়ে সিলেটসহ সারা দেশে। ভারতীয় পণ্য বহণকারী ছোট পিকআপ ভ্যান চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালনার ফলে প্রতিনিয়ত ঘটছে নানা ঘটনা দুর্ঘটনাও।
বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, গোয়াইনঘাট সীমান্তের বিছনাকান্দি, সোনারহাট, লাখাট, দমদমিয়া, পান্তুমাই, কোম্পানীগঞ্জের উৎমা, লামাগ্রাম, তুরং, বরমসিদ্ধিপুর, নোয়াগাও সীমান্ত এলাকা দিয়েই অবৈধ পথে সিংহভাগ ভারতীয় অবৈধ পণ্য আসে। চোরাই পণ্য বিক্রিতে লাভ বেশি। শুল্ক ছাড়া এসব পণ্যের বাজার মূল্য অনেক কম থাকে। এ কারণে দেশীয় উৎপাদনমুখী শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভারতীয় পণ্যের কাছে মূল্য ও মানে অনেক দেশীয় পণ্য মার খাচ্ছে। এ ছাড়া বৈধপথে আমদানিকারকরাও এতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। বেশি লাভজনক হওয়ায় বৈধ আমদানির চেয়ে অবৈধ আমদানির দিকেই ঝুঁকছেন তারা। চোরাই পথে পণ্য আমদানির কারণে তামাবিল স্থলবন্দরের রাজস্ব আদায়ও বিপর্যয়ের মুখে। বিজিবি বলছে অবৈধ আমদানি বন্ধে কড়াকড়ির কারণে চোরাচালান চক্র ভিন্ন কৌশল নিয়েছে। তারা বিভিন্ন অরক্ষিত সীমান্ত এলাকা দিয়ে শুল্ক না দিয়েই পণ্য আমদানি করছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আদায়ে।
অভিযোগ উঠেছে, কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাটের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্য, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের যোগসাজশে সীমান্ত এলাকা দিয়ে হরহামেশাই অবৈধভাবে চোরাই পথে ভারতীয় পণ্য আসছে। ফলে সরকার বছরে কোটি কোটি টাকার শুল্ককর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। চোরাই পথে আসা ভারতীয় পণ্যের মধ্যে রয়েছে গরু, শাড়ি, থ্রি-পিস, মদ ফেনসিডিল, ইয়াবা, গাঁজা, বিয়ার, মোটর সাইকেল, বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, গরু মোটা-তাজাকরণের স্টেরয়েড ট্যাবলেট, পেঁয়াজ, লবন, প্রসাধন সামগ্রী। স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব চোরাই মালামালের কিছু কিছু মাঝে মধ্যে বিজিবি আটক করলেও পরবর্তীতে কাস্টমসে জমা দেয়ার আগে বেশিরভাগই পেছনের দরজা দিয়ে চলে যায় চোরাই সিন্ডিকেটের হাতে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চোরাচালানী লাগেজ পার্টির মূল মালিক বা মহাজনরা বৈধপথে ভারতে গিয়ে কোটি কোটি টাকার গরু, শাড়ি, থ্রি-পিস, মদ ফেনসিডিল, ইয়াবা, গাঁজা, বিয়ার, মোটর সাইকেল, বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, গরু মোটা-তাজাকরণের স্টেরয়েড ট্যাবলেট, পেঁয়াজ, লবন, ফেয়ার এন্ড লাভলিসহ বিভিন্ন কসমেটিকস কিনে ভরতের সীমান্তবর্তী এলাকার নির্দিষ্ট ব্যক্তির হেফাজতে রেখে আসে। পরে সময় সুযোগ বুঝে ভারত ও বাংলাদেশের দালালরা কমিশনের মাধ্যমে ওইসব মালামাল (লেবার/কামলা) হাজিরায় নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেয়।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ সীমান্তে গোয়াইনঘাট উপজেলার পিরের বাজারের কামাল মেম্বার, ডৌবাড়ি ইউনিয়নের মতিন মিয়া, জয়নাল আবেদিন, বিছনাকান্দি গ্রামের ওহাব আলী, করিম মিয়া, নেছার আহমদ, রহিম মিয়া, নাছির মিয়া, জিয়া, ছড়ার পাড়ের নজু মিয়া, দমদমা গ্রামের গিয়াস উদ্দিন, মুজিবুর রহমান, সুহেল আহমদ লাগেজ পার্টির নিয়ন্ত্রক। চোরাকারবারী চক্রের গডফাদার হিসেবে তাদের পরিচিতি। এসব এলাকায় মাদকের বাজার ধরে রেখেছেন বিছনাকান্দির আবু সাঈদ, দমদমা গ্রামের কালা মিয়া, কোম্পানীগঞ্জের উৎমা লামাগ্রামের আলাল, হবি, তুরং গ্রামের দুলাল, শাহিন ও ইকবাল। এদের রয়েছে একাধিক লাইনম্যান, স্পাই। বিভিন্ন সীমান্তে রয়েছে প্রায় শতাধিক সঙ্গবদ্ধ চোরাচালানী। এরা প্রতিনিয়ত সীমান্ত দিয়ে মালামাল নিয়ে আসে।
এলাকাবাসী জানান, চোরাকারবারীরা সীমান্ত এলাকায় তাদের মনোনীত পাহারাদার বসিয়ে রাখে। এসব পাহারাদারদের ছত্রছায়ায় লাইনম্যানরা প্রতি কিলোমিটারে মাদকের চালানের জন্য ৫০০ টাকা, গরু প্রতি ১ হাজার টাকা, মহিষ ২ হাজার টাকায় বিভিন্ন পয়েন্টে এক লাইনম্যানের কাছ থেকে অপর লাইনম্যানের কাছে পৌঁছে দেয়। স্থানীয়রা বলছেন, কোম্পানীগঞ্জ-গোয়াইনঘাট সীমান্ত এলাকায় করিডোর অথবা বিট/খাটাল না থাকায় প্রতি বছর সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে।
দমদমিয়া বিজিবি ক্যাম্প কমান্ডার মোহাম্মদ হাশেম বলেন, এই চোরাচালানীদের সাথে বিজিবির কোন সদস্য জড়িত নয়। তবে কারো সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে। তদন্তে বিজিবি’র কোন সদস্য এই চোরাকারবারীদের সাথে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন ভারতীয় অবৈধ মালামাল বাংলাদেশে যেন কোন ভাবে ঢুকতে না পারে সেজন্য আমাদের কঠোর নজরদারি রয়েছে, বিজিবি প্রচুর চোরাইপণ্য প্রতি মাসেই জব্দ করছে। আমরা এবছরের চলিত মাস ফেব্রæয়ারির শুরু থেকে এ পর্যন্ত ১শ গরু আটক করেছি। চোরাচালানকারীদের উপর ২০টি মামলা করেছি, উদ্ধারকৃত মালামালের মূল্য প্রায় ৪২ লক্ষ ৩৮হাজার টাকা।
বিছনাকান্দি বিজিবি ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার সুবেদার বাছেত বলেন, সীমান্ত থেকে চোরাকারবারীদের মাধ্যমে নিয়ে আসা গরু-মহিষ আটক করতে আমরা ২৪ ঘণ্টা ডিউটি করে থাকি। কিন্তু কোনো ভাবেই এদেরকে পুরোপুরি দমন কিংবা গরু চোরাচালান রোধ করা যাচ্ছে না।
বিছনাকান্দি বিজিবি ক্যাম্পে কর্মরত বিজিবি’র ডিএসবি সদস্য আরিফ বলেন, সীমান্ত এলাকায় বিজিবি এখন খুবই সতর্ক, কঠোরভাবে চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। সীমান্ত এলাকায় বিজিবি কঠোর অবস্থানে আছে।