মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ
জেলা প্রশাসক, সুনামগঞ্জ।
হাওরকন্যা হিসেবে খ্যাত সুনামগঞ্জ সিলেট বিভাগের অন্যতম একটি জেলা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সাংস্কৃতিক প্রাচুর্য এই অঞ্চলটিকে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য দান করেছে। হাসন রাজা, দূর্বিন শাহ, রাধারমণ ও শাহ আব্দুল করিমের এই দেশে সাংস্কৃতিক বিকাশ হলেও শিক্ষা ক্ষেত্রে এই অঞ্চলটি নিকটবর্তী জেলাসমূহ হতে অনগ্রসর অবস্থানে আছে। দেশবরেণ্য অনেক ব্যাক্তি এই অঞ্চলের সন্তান হলেও আর্থসামাজিক ও শিক্ষাগত উন্নয়নে আশানুরূপ ও দৃশ্যমান উন্নয়ন এখনো গুণগত মানসম্পন্ন হয়নি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গঠনে দেশনেত্রী শেখ হাসিনার ১০টি বিশেষ উদ্যোগের অন্যতম একটি উদ্যোগ হলো “শিক্ষা সহায়তা উদ্যোগ”। এই পদক্ষেপ বাস্তবায়নের জন্য নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু হাওর অঞ্চলে প্রতিকূল প্রাকৃতিক অবস্থা ও দারিদ্রতার কারণে প্রাথমিক শিক্ষা এখনো আশানুরূপ অবস্থানে যেতে পারেনি।
সুনামগঞ্জে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৪৩৩ টি যা ১১টি উপজেলার জন্য অপ্রতুল। নতুন প্রকল্পের আওতায় আরও নতুন নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। সম্প্রতি ২৫৫৩ জন শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণ করা হয়েছে যা প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি বড় সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে নতুন পদ সৃজন, ক্লাসরুমের পরিবেশ উন্নয়ন,মিড-ডে মিল চালুকরণ, উপবৃত্তি, বছরের প্রথমে নতুন বই সরবরাহসহ সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। জেলা প্রাশাসনের নানামুখী উদ্যোগে প্রাথমিক শিক্ষা নানা রকম শিক্ষাসহায়তা পাচ্ছে। ২০১৯ সালে প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির হার প্রায় ৯৮.৫৩% যা থেকে বোঝা যাচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষায় ছাত্রছাত্রীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ঘটছে। স্কুলের সংখ্যা, ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা, বিদ্যালয়ের সংখ্যাসহ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশের ব্যাপক উন্নয়ন প্রাথমিক শিক্ষায় নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে সুনামগঞ্জে প্রাথমিক শিক্ষার চালচিত্র খুব দ্রুতই পরিবর্তন হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
সুনামগঞ্জে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন প্রতিনিয়ত নানারকম বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হচ্ছে যা এখানকার প্রাথমিক শিক্ষার নিরবিচ্ছিন্ন উন্নয়নে বাধা তৈরী করছে। হাওর অঞ্চল হওয়ার কারনে বছরের প্রায় ৬ মাসের বেশি সময় এই অঞ্চলটি পানিতে নিমজ্জিত থাকার কারনে স্কুল এবং স্কুলে যাওয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থার অবনতি হয় ফলে অনুপস্থিতির হার অনেক বেড়ে যায়। শিক্ষকদের অনুপস্থিতি প্রাথমিক স্কুলের অবস্থার আরও অবনতি করে কারণ হাওর অঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ স্কুলে গরহাজির থাকেন ফলে স্কুলে পাঠদান ব্যাপক ভাবে ব্যাহত হয়।
একটি শিশুর সার্বিক বিকাশে লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা ও বিনোদনের প্রয়োজন রয়েছে কিন্তু এই অঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের খেলাধুলা ও বিনোদনের ঘাটতি রয়েছে। শিক্ষকদের অনুপস্থিতি শিশুদের বিনোদনের পরিবেশকে ব্যাহত করছে ফলে শিশুরা বিদ্যালয়ে আশার উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে। প্রাথমিক শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নে প্রয়োজন শিশুদের খেলাধুলা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করা। শিশুদের সার্বিক বিকাশে খেলাধুলা ও বিনোদনের অভাব একটি বড় অন্তরায়। এখনও এই অঞ্চলে প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পরার হার প্রায় ১০ ভাগের উপরে।
দারিদ্র্য এই অঞ্চলের প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে একটি বড় অন্তরায়। দারিদ্রতার কারনে এখানকার মানুষ শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করার ভয়ে সন্তানদের স্কুলে প্রেরণ করতে চান না বা করলেও বেশিদিন চালিয়ে যেতে চান না। ফলে কোমলমতি শিশুরা শিশুশ্রমে তাদের শৈশব হারিয়ে ফেলছে। তাছাড়া দুর্বল আর্থিক অবস্থার কারনে মেয়েরা বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে ফলে প্রাথমিক শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহনের হার অনেক কমে যাচ্ছে। অজ্ঞতা ও সচেতনতার অভাব এখানকার প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে বাধা তৈরি করছে। হাওর অঞ্চলের অনগ্রসর মানুষ শিক্ষার সুফল সম্পর্কে সচেতন নয় ফলে তারা তাদের সন্তানদেরকে স্কুলে পাঠাতে চায় না। দারিদ্রতা ও কুসংস্কারের ফলে হাওর অঞ্চলের মানুষের শিক্ষার প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়েছে যা প্রাথমিক শিক্ষার বিকাশে একটি বড় বাধা। কৃষিভিত্তিক এই অঞ্চলে ধান কাটার মৌসুমে শিশুরা পারিবারিক ভাবে কর্মে নিযুক্ত হয় এবং এই সময় তাদের বিদ্যালয়ে যাওয়া ব্যহত হয়।
অবকাঠামোগত সমস্যা প্রাথমিক শিক্ষার বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে। স্কুলগুলোর অবকাঠামো দুর্গম অঞ্চলে খুবই নাজুক। তাছাড়া প্রতিবছর বন্যার কারনে এখানকার স্কুল অবকাঠামো অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ১৪৭০ টি স্কুলে ৮৪৫ টি ল্যাপটপ ও ৮২৫ টি মাল্টিমিডিয়া স্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া সরকার থেকে আরও অনেক সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয়েছে।কিন্তু এসব অবকাঠামো ও প্রযুক্তি; অব্যবস্থাপনা ও দুর্যোগের কারনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখনও অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের দুরবস্থা সেখানকার শিক্ষার পরিবেশকে ব্যাপকভাবে ব্যাহত করছে।
দুর্নীতি, অনিয়ম এবং অব্যাবস্থাপনা এখানকার প্রাথমিক শিক্ষাকে অনেকভাবেই বাধাগ্রস্ত করছে। প্রধান শিক্ষকদের দুর্নীতিমূলক মনোভাব, শিক্ষকদের বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতি, অবকাঠামোগত কাজে দুর্নীতি, সরকারী বরাদ্দের অপব্যবহার ইত্যাদি নানা কারনে এখানকার প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উল্লেখ্য যে, দুর্যোগকালীন সময়ে,বিশেষত বন্যার সময় এখানে শিক্ষকদের উপস্থিতি খুবই কম। ২০১৮ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীতে পাশের হার ৯১.৯৫ শতাংশ হলেও অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ফলাফল মোটেও সন্তোষজনক নয়।
আশার বিষয় হলো শিক্ষার মান-উন্নয়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে সরকার আপোষহীন উন্নয়ন কর্মসূচি নিয়েছে যার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষাকে হাওরের প্রতিটি শিশুসন্তানের নিকট পৌছে দিতে সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং আন্তরিক। তাই অচিরেই হাওরের শিক্ষা-ব্যবস্থার এবং প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত চিত্রপটের আমূল পরিবর্তন ঘটবে এই আশাবাদ ব্যক্ত করা যাচ্ছে।
জেলা প্রশাসক, সুনামগঞ্জ।