সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি : যাদুকাটা গিলে খাচ্ছে রতন-মঞ্জু চক্র। একদিকে এই চক্রের ড্রেজার মেশিনের তাণ্ডবে প্রতিদিন ক্ষত বাড়ছে যাদুকাটার বুকে। অপরদিকে সীমানা অতিক্রম করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন বারকি নৌকা ঢুকছে ভারতীয় সীমান্তে। আর সীমান্ত অতিক্রম কালে ভারতীয় বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারাচ্ছে অনেক শ্রমিক। যাদুকাটায় ইজারাদার চক্রের এই অবৈধ তান্ডব যজ্ঞে আতংক বিরাজ করলেও কার্যকর পদক্ষেপ নেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। তবে স্থানীয়রা বলছেন ইজারাদার চক্রের এই অবৈধ তাণ্ডব না থামালে যেকোনো সময়ে দু’দেশের মধ্যে অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি ঘটতে পারে। শুক্র ও শনিবার রতন-মঞ্জু চক্রের নির্দেশে বারকী নৌকা ভারতীয় সীমান্তে প্রবেশের দুটি পৃথক ভিডিও ফুটেজ থেকে এই তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, যাদুকাটা নদী থেকে প্রতিবছর প্রায় পাঁচ কোটি ঘনফুট বালি, এক কোটি ঘনফুট নুড়ি, বোল্ডার ও ভাঙ্গা পাথর আহরণ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়ে থাকে। নদীটিতে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক কাজ করে থাকে। এর মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার হচ্ছেন বারকি শ্রমিক । (২ ফুট প্রস্ত আর ৪০ ফুট দীর্ঘ একটি বারকি নৌকা। সাধারণত ২ জন শ্রমিক একটি বারকি নৌকা পরিচালনা করে থাকেন। নদী থেকে বালি কিংবা পাথর সংগ্রহ করে বারকি নৌকা বোঝাই করা হয়। একটি বারকি নৌকায় ৪০ থেকে ৫০ বর্গফুট বালি কিংবা পাথর নেওয়া যায়। নদীটিতে প্রতিদিন চলাচলকারী শত শত বারকি নৌকার সারি যাদুকাটা নদীর রুপকে অপরুপ করেছে। তবে যাদুকাটার বুকে এমন দৃশ্য এখন স্বাভাবিক নয়। যন্ত্র দানব ড্রেজার মেশিনের তাণ্ডবযজ্ঞে নদী হারাচ্ছে নাব্যতা। অবৈধ ড্রেজার-বোমা মেশিন দিয়ে ইজারার নামে সরকারী রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে লুটে নেওয়া হচ্ছে বালু ও পাথর।
স্থানীয়দের তথ্যমতে যাদুকাটা নদীর ইজারদার রতন ও খন্দকার মঞ্জুর আহমদ। এর মধ্যে রতন হচ্ছেন সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য বহুল আলোচিত এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের প্রিয়জন। অপর ইজারাদার খন্দকার মঞ্জুর আহমদও এমপির নিজস্ব লোক। রতন-মঞ্জু চক্র যাদুকাটা নদীর বারেক টিলা ঘেঁষে ভারতীয় অংশে প্রতিদিন পাঠাচ্ছে বারকি। সেখান থেকে সীমানা আইন লঙ্ঘন করে শ্রমিকদের মাধ্যমে আসছে বালি ভর্তি নৌকা। মোট কথা, একদিকে ড্রেজার মেশিনের দানবীয় তাণ্ডব অপরদিকে বালু সংগ্রহে অবৈধভাবে ভারতীয় অংশে অনুপ্রবেশ ঘটনা। সবমিলিয়ে যাদুকাটায় বসতিদের মধ্যে বিরাজ করছে আতঙ্ক। যেকোনো সময়ে দু’দেশের মধ্যে সংঘর্ষ এবং প্রাণ বিপর্যয়ের আশঙ্কা বিদ্যমান। যাদুকাটার বুকে প্রকাশ্যে প্রতিদিন বালু খেকো মঞ্জু ও রতন চক্রের বালু মিশন চললেও জানমালের ভয়ে নির্বিকার থাকেন ষ্থানীয়রা।
এর আগে ৩২ টি হাওর রক্ষার দাবিতে কথিত ইজারাদার রতন ও খন্দকার মঞ্জুর আহমদের শাস্তির দাবিতে গেল ৯ জুলাই তাহিরপুর পূর্ব ‘বাজারস্থ আমরা হাওরবাসী’ ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। হাওরের অনেক জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়রাও বহুবার প্রকাশ্যে কথা বলেছে ইজারদার চক্রের বিরুদ্ধে। কিন্তু এই চক্রের নেপথ্যে রাজনৈতিক শক্তির প্রভাব থাকায় দমে থাকেনি রতন-মঞ্জুর যাদুকাটা নিধন যজ্ঞ। এর ফলে যাদুকাটা তার স্বাভাবিক অস্থিত্ব হারিয়ে ফেললেও সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা থাকে নীরব।
জানা গেছে, গত এপ্রিল মাসে তাহিরপুর উপজেলার যাদুকাটা নদীর দুটি বালু মহাল ইজারা দেওয়া হয়। যার মধ্যে রয়েছে যাদুকাটা বালি মহাল-১(এক) যার মুল্য ২০ কোটি ২০ লক্ষ টাকায় ইজারা খাজনা পরিশোধ করে ইজারাদার হিসেবে দখল বুঝে নেন রতন বাড়ি এবং যাদুকাটা ২নং বালু মহাল ইজারা পান খন্দকার মঞ্জুর আহমদ যার ইজারা মুল্য প্রায় ৩৪কোটি টাকা। খাজনা পরিশোধ করার বিধান থাকলেও, ২-নং বালি মহালের খাজনা এখনো পরিশোধ করা হয়নি।
যাদুকাটা দুই এর খাজনা পরিশোধ না করেই সিন্ডিকেট তৈরী করে যাদুকাটা বালু মহাল-১,এবং যাদু কাটা বালু মহাল-২,এর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত ইজারাবিহীন খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর বালু মিশ্রিত পাথর মহাল এবং খনিজ সম্পদের ফাজিলপুর বালি মিশ্রিত পাথর মহাল থেকে আবাধে প্রতিদিন রাতের আঁধার অবৈধভাবে ড্রেজার মেশিন দিয়ে শতশত ষ্টীল বডি বাল্কহেড নৌকা বুঝাই করে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কোটি কোটি টাকার বালু ও পাথর।
শুধু তাই নয় সরেজমিনে ঘুরে এবং স্থানীয়দের সাথে আলাপ করে খোঁজ নিয়ে জানা যায়। ফাজিলপুর বালি মিশ্রিত পাথর মহালটি সরকারের মন্ত্রী পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। অথচ জেলা যুবলীগ আহবায়ক ও সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্যের সাথে সিন্ডিকেট তৈরী করে সেই রক্ষিত ফাজিলপুর বালি মিশ্রিত পাথর মহাল থেকে কোটি কোটি টাকার বালি ও পাথর লুট করে নিয়ে যাচ্ছে অবৈধ ড্রেজার বোমা মিশিন দ্বারা উত্তোলন করে দুই ইজারাদার।
প্রশাসনের চোখের সামনে বর্তমান দুই ইজারাদারের সিন্ডিকেটের লোকেরা এসব তান্ডব চালিয়েছেন। রহস্যময় কারনে এসব তান্ডবলীলার কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছেনা। শুধু তাই নয়, নদীর তীর কেটে ড্রেজার মেশিন দিয়ে প্রতিনিয়ত প্রকাশ্যে নেওয়া হচ্ছে বালি ও পাথর, যার ফলে ইতিমধ্যেই নদীগর্ভে বিলীন হতে চলেছে শতশত নদীর তীরে থাকা অসহায় মানুষের ঘরবাড়ি, রাস্থা ঘাট ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান।
অন্য দিকে ঐ সমস্ত অবৈধ বোমা ড্রেজার মেশিনের তান্ডবের কারনে ৪০টি গ্রামের প্রায় ২০হাজার শ্রমিক তাদের কর্মসংস্থান হারিয়ে বেকার হয়ে পরেছেন। যা সাবেক ইজারাদারদের বেলায় এমনটি হয়নি। শত বছর যাবৎ এই যাদু কাটা নদীতে প্রায় ৪০টি গ্রামের হাজার হাজার শ্রমিকরা বেলচা ও বালতি দিয়ে বালু,জুরি পাথর, লাকড়ি, পাহাড়ি ঢলে ভেসে আসা বাংলা কয়লা উত্তোলন করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করেন। আর এসমস্ত শ্রমজীবী শ্রমিকদের ভাগ্যে কুড়াল মেরে যাদু কাটা বালি মিশ্রিত পাথর মহালগুলিতে দানব মেশিন ড্রেজার বোমা দিয়ে প্রতিদিন চলছে বালু উত্তোলন।
উল্লেখ্য প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর দেশের অন্যতম সৌন্দর্যের নদীর নাম যাদুকাটা। যাদুকাটা নদীর ওপারে মেঘালয়ের বিশাল পাহাড় আর এপারে তাহিরপুর উপজেলা। ভারতের মেঘালয় থেকে উৎপন্ন হয়ে যাদুকাটা নদী উপজেলার উত্তর পূর্ব প্রান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এ কারণে দুই দেশের সীমান্তে নদীটি অপরুপ দৃশ্য ধারণ করেছে। বর্ষায় এর বুকদিয়ে প্রবাহিত নদীর তীব্র স্রোতধারা আর হেমন্তে শুকিয়ে যাওয়া নদীর বুকে জমে উঠে ধুধু বালুচর। মেঘালয় থেকে নেমে আসা বালি আর পাথরের কারণে নদীটি সম্পদশালী ও গুরুত্বপূর্ণ। এর সবুজাভ স্বচ্ছ পানি পর্যটকদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। সে এক মন মাতানো দৃশ্য! কিন্তু প্রকৃতির মুগ্ধতা ছড়ানো সেই দৃশ্য এখন আর নেই! একের পর এক যাদুকাটার উপর তাণ্ডব চালাচ্ছে মানুষরূপী দানব চক্র। হাওর প্রেমী মানুষ এই চক্রের বিরুদ্ধে কথা বলেছে বারবার। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব আর পেশি শক্তির দুর্দণ্ড প্রভাব থাকায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও নীরব থাকেন। অবশ্য বিনিময়ে থানা-পুলিশের পকেট ভাড়ি হচ্ছে প্রতিদিন।