অজয় বৈদ্য অন্তর:: বাংলাদেশ বহুকাল থেকেই ‘নদীমাতৃক দেশ’ হিসেবেই পরিচিত। হাজার বছর আগে এখানকার ওপর দিয়ে বহমান নদ-নদীগুলো উজান থেকে যে কোটি কোটি টন পলি নিয়ে এসেছে সে সুবাদেই এই দেশের জন্ম। তা ছাড়া দেশের বুকের ওপর যে শত শত নদী এখনো প্রবাহিত হচ্ছে তা এখানকার মানুষ আর প্রাণী ও জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করে যাচ্ছে। কৃষি আর মৎস্যসম্পদের ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রেখে চলেছে। নদী এ দেশের মানুষের বেঁচে থাকার অবলম্বন আর আশীর্বাদ বলে ধরে নেয়া হয়।
মনে পড়ে শৈশবে দেখা নদীর কথা। কি প্রমত্তা, কি স্রোতস্বীনি সেই নদীগুলো যে দেখেনি, তাকে বোঝানো মুশকিল। জেলের নৌকাগুলো কী ভয়ংকরভাবে নাচছে, এই বুঝি পানির তলে হারিয়ে যাবে। ওই যে, শুশুক কী তাণ্ডবে না নিশ্বাস নিল পানির ওপরে, মাছগুলো ভয়ে দিগ্বিদিক লাফাচ্ছে। এসব দেখতে দেখতে শৈশবের কত সময় কেটেছে সিলেটের বিভিন্ন উত্তাল নদী আর মাটিতে। সময় যেমন অনেক গড়িয়ে গেছে, তেমনি নদীরাও যৌবন হারিয়ে বার্ধক্যে এসে উপনীত হয়েছে।
সিলেট জেলার মোগলাবাজার ইউনিয়নের মোগলাবাজারের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কেশরখালি নদী। কেশরখালি নদীটি সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর শাখা ছিলো । যে নদী এতোটাই বড় ছিলো যে একসময় বড় বড় জাহাজ চলতো। যে নদী দিয়ে রংপুর, দিনাজপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে অনেক দূর দূরান্তে জাহাজ করে মালামাল আসা যাওয়া করতো। ধান সহ বিভিন্ন ধরনের পন্য আসা যাওয়া করতো। যে নদী ছিলো হাজারো মানুষের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম।
কৃষিজীবি ও সাধারণ মানুয়ের একমাত্র জীবন নির্বাহের পাথেয় ছিলো এই নদী। জেলেরা বড় বড় নৌকা দিয়ে দলবেঁধে মাছ ধরতো। আর এদের প্রবাহকে ছড়িয়ে দিতে উপশিরার কাজ করছে শাখা নদী ও খালগুলো। শিরা কিংবা উপশিরা সবই আজ শুকিয়ে মরণাপন্ন, যেমনটা ফিকে হয়ে যাচ্ছে আমার ছোটবেলার স্মৃতিতে থাকা জল আর জলতরঙ্গ।
মোগলাবাজার সংলগ্ন এলাকার মুরুব্বিয়ানদের থেকে জোনা যায়, উনার বাবারা গল্প করেছেন, কত দৃশ্য দেখেছেন এই কেশরখালি নদীর ঢেউ, মাছধরা কিশোরের কল্পকাহিনী, তার সীমা নেই। আগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই কেশরখালি নদী হয়ে লঞ্চ কিংবা জাহাজে করে ভ্রমণ করেছেন,এই দৃশ্য দেখেছেন তাদের বাবা দাদারা। সময়ের পরিক্রমায় এসব শুধুই স্মৃতি। এখন নদীগুলো যে গতিতে নাব্য হারাচ্ছে, তার চেয়েও বেশি গতিতে হারিয়ে যাচ্ছে মাছরাঙ্গার মতো এসব নদীর সাদা বক।
একদিকে যেমন পানির প্রবাহ কমে গিয়ে নদীগুলো মরে যাচ্ছে, তেমনি বিষাক্ত বর্জ্য নদীগুলোর পানিকে বিষাক্ত ও ব্যবহারের অনুপযোগী করে তুলছে। মরাগাঙের দশার পাশাপাশি সিলেটের চার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সব নদ-নদীও কেশরখালি নদীর মতোই চরের দশায় উপনীত হচ্ছে।
কী আবেগ, ভালোবাসা আর স্মৃতির পরশ জড়িয়ে আছে নদীর সঙ্গে। অথচ আমাদের সামনেই দিন দিন কেমনভাবে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রাণের স্পন্দন, জীবনতরঙ্গ নদীগুলো। আবার কি জীবন জোয়ারের তাণ্ডবে নদীগুলোকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব? সম্ভব কি সেই উত্তাল ঢেউ,শুকিয়ে যেতে বসা সেই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে আবার প্রাণের জোয়ার ফিরে আনা?
এবিএ/১৫ জানুয়ারি