অজয় বৈদ্য অন্তর:: কিছু কিছু মানুষের জীবন গল্পের চেয়েও ঘটনাবহুল হয় তার কর্মে, মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেয় স্বীয় সাধনায়, স্বর্ণপদক জয়ী জুইঁও তাদেরই একজন। শিল্পীর জীবন সাধারণ মানুষের চেয়ে একটু ভিন্ন, তাঁর দেখবার চোখ অনন্য, ভাবনার শক্তিও গভীর। সে-কারণেই একজন জুঁই কেবল তাঁর নিজের থাকেনি, হয়ে উঠেছে সিলেট-সুনামগঞ্জ ভাটি অঞ্চলের সামগ্রিক এক জীবনচিত্র, সময়ের ছবি।
ভাটির দেশের প্রকৃতিই যে ওখানকার মানুষের মনের মধ্যে সুরের মায়াজাল বিস্তার করে দিয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। বছরের প্রায় ছয় মাস জলাবদ্ধতার কারণে সেখানকার জীবন থমকে থাকতো। তখন গান-বাজনা, যাত্রা-নাটক করে বিনোদন খোঁজার চেষ্টা করত ভাটি অঞ্চলের মানুষ। আর প্রকৃতির বৈচিত্র্যই তাদের মনকে করে তুলতো অনুভূতিপ্রবণ, সংবেদনশীল। ফলে সুর এবং গানই হয়ে উঠেছিল সেখানকার জীবনধারার এক অনন্য বৈশিষ্ট্য।
সরকারি অগ্রগামী বালিকা বিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে বাংলাদেশ বেতার সিলেটে অডিশন দিয়ে কিশোলয় বিভাগে সুযোগ পাওয়ার মাধমেই তার পেশাগত শিল্পী জীবন শুরু হয় জু্ঁইয়ের।
ইংরেজী সাহিত্যের শিক্ষার্থী হলেও জুঁই তালুকদারের ধ্যান-জ্ঞ্যান পুরোটাই সংগীত নিয়ে।সংগীত পরিবেশন করতে ঘুরে বেড়িয়েছেন সিলেট শহরের অলিতে-গলিতে,হয়ে উঠেছেন সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পরিচিত মুখ।।সুরের মাধুর্যে তিনি মুগ্ধ করেন শ্রোতাদের। গানেই নিজে অনুভব করেন পরম শান্তি।
শ্রুতি নাটক ও কবিতা আবৃত্তিতে বেশ সুনাম অর্জন করলেও জুঁই নিজেকে সংগীতের প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পী হিসেবে পরিচিতি দিতেই বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সংগীতের সাথে জড়িয়ে আছে তাঁর কত স্মৃতি।
অনেকটা আবেগাপ্লুত হয়ে এই জগতে আসার গল্প বললেন এভাবে, “সংগীত নিয়েই আমার আজীবনের স্বপ্ন। আমার জন্ম সুনামগঞ্জের, দিরাই এর জয়পুর গ্রামে। সিলেটে আসি ৫ বছর বয়সে, বাবার হাতেই ৬ বছর বয়সে সংগীতে হাতেখড়ি, প্রাইমারী পড়েছি লামাবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে,যখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি তখন জীবনে প্রথম বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলায় দেশের গানে বিভাগীয় পর্যায়ে প্রথম হই।
এই প্রতিযোগিতার পরেই আমার গানের প্রতি আগ্রহ জন্মে, মূলত তখন থেকেই গানের প্রতি একটা ভালোবাসার জায়গা তৈরি হয়,তারপর মূল গান এর হাতেখড়ি হয় আমার সংগীত গুরু বাংলাদেশ বেতার এর শিল্পী প্রয়াত করুণাসিন্ধু চৌধুরী’র আর উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পী প্রিয়াঙ্কা দাস তিথির কাছে।বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে ৪ বছর সংগীত এ হাতেখড়ি নেই, ইতি ভৌমিক বর্ষা মজুমদার এবং অনিমেষ বিজয় চৌধুরীর কাছে।”
দেশাত্মবোধক গানের নিয়মিত শিল্পী হওয়ার পাশাপাশি সিলেট বেতারের প্রিয় অনুষ্টান যেমন কিশোলয়,সবুজমেলা আর নবকল্লোলে সংগীত পরিবেশন করে শ্রোতাদের মনে জায়গা করে নেয় কিশোরী জুঁই।
মাধ্যমিকে থাকাকালীন সময়েই সিলেটের সাংস্কৃতিক সংগঠন সংগীত পরিষদে গুরুজী পণ্ডিত রামকানাই দাশের কাছে উচ্চাংগ সংগীতের তালিম নিয়েছিলেন তিনি, নজরুল সংগীত এর প্রতি একটা ঝোঁক তৈরি হয় সেই সময় থেকেই।
স্কুলের পাঠ চুকিয়ে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন সিলেট সরকারি মহিলা কলেজে।শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় কলেজ জীবনে দুইবার বিভাগীয় নজরুল, লোকগীতি আর উচ্চাঙ্গ সংগীত নিয়ে উপজেলা, জেলা বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন।
সংগীত জীবনে এসেছে বহু বাধা,পেয়েছেন অনেক কষ্ট তবু থেমে থাকেন নি।বিশেষত ২০১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় সংগীত বিভাগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েও অর্থনৈতিক কারণে পিছু হটতে হয়েছে,স্বপ্নের কাছাকাছি গিয়েও ফিরে আসতে হয়েছে।তবে তিনি হতাশ হন নি, দ্বিগুণ উদ্যমে চালিয়ে যাচ্ছেন সংগীত চর্চা।সংগীত নিয়ে পড়ার ইচ্ছা এখনো এতোটাই প্রবল তাই’তো জুঁই প্রতিনিয়ত শিখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
সিলেট সরকারী মহিলা কলেজে অনার্স তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত জুইঁ প্রথম বর্ষেই বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে চ্যাম্পিয়ন হন। ২০১৬ সালে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে সিলেট বিভাগ থেকে নজরুল, উচ্চাঙ্গসংগীত ও লোকসংগীত নিয়ে সারা সিলেট বিভাগে তিনি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে জাতীয় পর্যায়ে গিয়েছিলেন।
মুজিব বর্ষ আন্তঃকলেজ ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ২০২১ এর জাতীয় পর্যায়ে দেশ সেরা অর্থাৎ সারা বাংলাদশে তিনি নজরুল সংগীতে প্রথম স্হান অধিকার করে স্বর্ণপদক অর্জন করেন । বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ বেতার সিলেট কেন্দ্রের একজন নিয়মিত নজরুল সংগীত শিল্পী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত আছেন, আর উচ্চাঙ্গসংগীত এ ভারতের গুরুদের কাছে তালিম নিচ্ছেন। থিয়েটার আন্দোলন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত আছেন তিনি।এছাড়াও, তিনি বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমেও বেশ সক্রিয়।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে সদা হাস্যোজজ্বল জুঁই বলেন,” ভবিষ্যতে সংগীত এর উপর আমার উচ্চতর ডিগ্রী নেওয়ার খুব ইচ্ছা ভারতে গিয়ে, শুদ্ধ সংগীত নিয়ে আমি কাজ করবো। ভবিষ্যতে যদি সুযোগ পাই তবে উচ্চাঙ্গসংগীত ভালোভাবে আয়ত্ত্ব করে সিলেটের কোমলমতি শিশু আর শিক্ষার্থীদের জন্য একটা শুদ্ধ সংগীত নিকেতন করার চেষ্টা করবো, আমি আজীবন সংগীতের সাথে থাকতে চাই, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।আসলে সুর সাধনা খুব কঠিন কাজ, আমার রক্তের মধ্যে সুর টা মিশে গেছে যা আর কখনো ইচ্ছে করলেও মুছতে পারবো না। আমি যতদিন বাঁচবো সংগীত, সুর কে ধারণ করে রাখব’।
এবিএ/ ০৩ জানুয়ারি