বিকাশের কাছ থেকে কমিশন ব্যাণিজ্যের বিষয়ে তিনি বলেন, বকেয়া অর্থ বিতরণ করার জন্য বিকাশ হিসাব খোলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট থেকে চলতি বছরের উপবৃত্তি বিতরণের জন্য শিক্ষার্থীদের হিসাব খুলতে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। বকেয়া অর্থ বিতরণ করতে কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি না থাকার পরেও কেন ‘বিকাশ’ হিসাব খুলতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি কোন কমিশন নেইনি। বিষয়টি খতিয়ে দেখবো।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ষষ্ঠ থেকে স্নাতক শ্রেণি পর্যন্ত ৪০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী উপবৃত্তির সুবিধা পাচ্ছে। চারটি প্রকল্পের মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে উপবৃত্তি বিতরণ করা হতো। সেকায়েপ (সেকেন্ডারি এডুকেশন কোয়ালিটি অ্যান্ড অ্যাকসেস এনহান্সমেন্ট প্রজেক্ট), সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্ট প্রোগাম ( সেসিপ), এসইএসপি (মাধ্যমিক শিক্ষা উপবৃত্তি প্রকল্প) ও এইচএসএসপি (উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রকল্প) এ চারটি প্রকল্পের মাধ্যমে উপবৃত্তি বিতরণ করা হতো। এরমধ্যে দুটি সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে বাকি দুটি সরকারের পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক ও এডিবি অর্থায়নে পরিচালিত হতো। এছাড়া স্নাতকের শিক্ষার্থীদের প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ফান্ড থেকে উপবৃত্তি দেওয়া হয়। ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ফান্ড গঠনকালে সিদ্ধান্ত ছিল, ষষ্ঠ থেকে স্নাতকের শিক্ষার্থীদের দেওয়া সরকারি উপবৃত্তি কার্যক্রম এই ট্রাস্ট ফান্ডের অধীনে আনা হবে। আইনি জটিলতাসহ প্রকল্পের কর্মকর্তাদের বাধার কারণে দীর্ঘ দিন বাস্তবায়ন হয়নি। সমন্বিত উপবৃত্তি প্রকল্প চালু করতে সেসিপ এর আওতায় ২০১৭ সালে একটি গবেষণা পরিচালিত হয়। গত বছরের ১৬ জানুয়ারি সেটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ অনুমোদন দেয়। গবেষণার সুপারিশের ভিত্তিতে উপবৃত্তি প্রকল্পগুলো এসইডিপি’র আওতায় এইচএসপি চালু করা হয়। স্কিমটি ২০১৮ সালের জুলাই থেকে চালু করার কথা থাকলেও গত বছরের অক্টোবর মাসে চালু হয়েছে। স্কিমের মাধ্যমে ২০১৭ সাল থেকে ১৯ সাল পর্যন্ত সেকায়েপসহ অন্যান্য প্রকল্পের বকেয়া উপবৃত্তি বিতরণ করা হলেও চলতি বছর উপবৃত্তির অর্থ বিতরণ করা হয়নি।
জানা গেছে, উচ্চমাধ্যমিকের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের (এইচএসসি পরীক্ষার্থী) তিন লাখ ২৬ হাজার শিক্ষার্থী উপবৃত্তির টাকা পায়নি। একাদশ শ্রেণিতে অধ্যায়নকালে তাদের সবাইকে ডাচ বাংলা বাংকের অনলাইন ব্যাংকিং রকেট হিসাবের মাধ্যমে উপবৃত্তির টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, উচ্চমাধ্যমিকের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের উপবৃত্তির সুবিধাভোগীদের রকেট হিসাব থাকার পরেও স্কিমের কর্মকর্তারা গত ফেব্রুয়ারি মাসে নতুন করে বিকাশ হিসাব খোলার নির্দেশা দিয়েছেন অধ্যক্ষদের। করোনার মধ্যে এ ঘোষনায় দুর্ভোগে পরে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা। সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’সহ অন্যান্য ব্যাংকের পরিচালিত মোবাইল ব্যাংকিং এ লেনদেন করতে বিকাশের চেয়ে সার্ভিস চার্চ কম। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানকে কাজ না দিয়ে স্কিম থেকে বিকাশ হিসাব খোলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের প্রতিষ্ঠানে গিয়ে বিকাশ হিসাব খোলা বাধ্যতামূলক করা হয়। করোনার কারণে গত ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের মধ্যেই এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে বলা হয়। করোনার কারণে অনেকে ‘বিকাশ’ হিসাব খুলতে পারেনি।
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা জানিয়েছেন, করোনাকালীন অনেক অভিভাবক ব্যবসা হারিয়েছেন। কেউ কেউ চাকরি হারিয়ে অর্থ সংকটে পরেছেন। অর্থ সংকটের কারণে তাদের সন্তানরা ঠিকমতো অনলাইনে ক্লাসে অংশ নিতে পারেনি। স্কিমের কিছু কর্মকর্তা অনৈতিক আর্থিক সুবিধা নিয়ে ‘বিকাশ’কে কাজ দেওয়ায় শিক্ষার্থীরা উপবৃত্তির টাকা পায়নি। ফলে উপবৃত্তির সুফল ভোগ করা শিক্ষার্থীদের অর্থ সংকটে পরতে হয়। অথচ রকেট হিসাবের মাধ্যমেই তাদের উপবৃত্তির অর্থ বিতরণ করা যেত বলে স্কিমের অনেক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
সূত্র জানায়, সার্ভারের মাধ্যমে বর্তমানে ষষ্ঠ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। স্কিমের কর্মকর্তাদের উদাসীনতায় বর্তমানে দ্বাদশ শ্রেণিতে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীরা একাদশ শ্রেণির উপবৃত্তির টাকা পায়নি। ষষ্ঠ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের তথ্য আগামী ৭ নভেম্বরের মধ্যে দিতে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠান প্রধানদের এইচএসপি-এমআইএস সার্ভারের লিংক ও পাস ওয়ার্ড দেওয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রণালয়ের এসপিএফএমএসপি প্রকল্পের কাজে এ সার্ভারটি ব্যবহৃত হয়েছিল। একাধিক অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষক অভিযোগ করেছেন, দিন-রাত চেষ্টা করেও সার্ভারে তথ্য আপলোড করতে পারছেন না। সার্ভারটি পুরাতন ও আপলোড সক্ষমতা কম থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছেন তারা।
নীলফামারির কিশোরগঞ্জ মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মো. মাহফুজার রহমান বলেন, এইচএসসি পরীক্ষার্থী ও দ্বাদশ শ্রেণির কেউই উপবৃত্তির টাকা পায়নি। এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা একাদশ শ্রেণির উপবৃত্তির টাকা রকেটের মাধ্যমে পেয়েছে। নতুন করে বিকাশ হিসাব খোলার সিদ্ধান্তে তারা দুর্ভোগে পরেছে। তিনি আরো বলেন, দিন রাত অপেক্ষা করেও দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রীদের তথ্য সার্ভারে আপলোড করা যাচ্ছে না।
স্কিম সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশের মাধ্যমিক স্তরের (স্কুল-মাদ্রাসা) ৩৪ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ষষ্ঠ শ্রেণিতে অন্তত ৩০ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। আর উচ্চমাধ্যমিক স্তরে আট হাজার (কলেজ-মাদ্রাসা) প্রতিষ্ঠানের চার থেকে পাঁচ লাখ শিক্ষার্থীর তথ্য আপলোড করতে হবে। সার্ভারটির সেই সক্ষমতা নেই। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত মাত্র ছয় লাখ শিক্ষার্থীর তথ্য আপলোপ হয়েছে। স্কিম অফিসে প্রতিদিন সারা দেশের হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আপলোড সমস্যার অভিযোগ আসছে। সমস্যা সমাধান করতে গত সোমবার সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সভা করেছেন স্কিম পরিচালক।
সূত্র জানায়, শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ ও হয়রানি বন্ধে উপবৃত্তির টাকা মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে সরাসরি অভিভাবকদের মোবাইলে পাঠাচ্ছে সরকার। আগে উপবৃত্তি প্রকল্প পরিচালকরা তাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতো। বিনিময়ে অনলাইন ব্যাংকিং পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে বিপুল অংকের কমিশন পেতো। সব উপবৃত্তি প্রকল্প এক ছাতার নিচে তথা প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের অধীনে নিয়ে আসার পর কমিশন কমিয়ে আনতে প্রতিযোগিতামূলক করার নির্দেশ দেন ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। শিক্ষার্থীদের পছন্দ মতো ব্যাংকিং হিসাব খোলার নির্দেশনা দেন তিনি। তবে স্কিমের কয়েক জন কর্মকর্তা উচ্চমাধ্যমিক ও সপ্তম থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব থাকার পরেও ‘বিকাশ’ হিসাব খোলার নির্দেশ দিয়েছেন। বিকাশকে এককভাবে কাজ দিয়ে বিপুল অংকের কমিশন হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
‘সেকায়েপ’ প্রকল্পের মাধ্যমে মাধ্যমিক স্তরের ২৫০টি উপজেলার সাত হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্তত ১৮ লাখ শিক্ষার্থীকে মাসিক উপবৃত্তি দেওয়া হতো। ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর থেকে টানাটানির কারণে উপবৃত্তি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এইচএসপি স্কিমটি পাস হলেও ২০১৮ সালে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে অধ্যায়নরত সাত লাখ শিক্ষার্থী আজও উপবৃত্তির বকেয়া সব টাকা পায়নি। যথাক্রমে দুই শ্রেণির চার ও ছয় কিস্তি উপবৃত্তির টাকা বকেয়া রয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, ‘সেকায়েপ’ প্রকল্পভুক্ত শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির অর্থ বিতরণ করতে অগ্রণী ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি ছিল। সরকারি এ ব্যাংকটি বিকাশের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকি কার্যক্রম পরিচালনা করতো। কিন্তু সরাসরি ‘বিকাশে’র সঙ্গে ‘সেকায়েপ’ উপবৃত্তি বিতরণের চুক্তি ছিল না। এইচএসপি স্কিমের কর্মকর্তারা অগ্রণী ব্যাংকের চুক্তির দোহাই দিয়ে সেকায়েপ প্রকল্পের বকেয়া উপবৃত্তির টাকা পরিশোধ করতে ‘বিকাশ’ হিসাব খোলার নির্দেশ দেন প্রতিষ্ঠান প্রধানদের।
পটুয়াখালীর খেপুপাড়া বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আনোয়ার হোসেন আজকালের খবরকে বলেন, আগে রকেটের মাধ্যমে ছাত্রীরা উপবৃত্তির টাকা পেতো। এখন সপ্তম থেকে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীদের বিকাশ অ্যাকাউন্ট খোলার নির্দেশনা পেয়ে খুলতে বলেছি। স্কুল বন্ধের মধ্যে এ ধরণের নির্দেশনা দুঃখজনক।
এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের এমডি (অতিরিক্ত সচিব) নাসরিন আফরোজ আজকালের খবরকে বলেন, শিক্ষার্থীদের সুবিধার জন্য তাদের পছন্দমতো মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব খোলার নির্দেশনা দিয়েছি। শুধু বিকাশে হিসাব খোলার নির্দেশনা দিয়ে থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে বকেয়া উপবৃত্তির টাকা পরিশোধ করতে প্রকল্পের চুক্তি অনুযায়ী হিসাব খুলতে পারবে।
এদিকে স্কিমের খসড়া ম্যানুয়েল নিয়ে গত ২৪ আগস্ট শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সভাপতিত্বে একটি ভার্চুয়াল সভা হয়েছে। সভায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে অধ্যায়নরত শতভাগ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তির জন্য আবেদন করার সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। নবম ও একাদশ শ্রেণিতে উপবৃত্তির আওতাধীন নয় এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতে নতুন ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীরা উপবৃত্তির জন্য আবেদন করতে পারবে। সিআরভিএস-এর আওতায় ব্যানবেইস কর্তৃক শিক্ষার্থীদের ইউনিক আইডি চালু না হওয়া পর্যন্ত জন্মসনদের নম্বর আবেদনকারী শিক্ষার্থীর আবেদনের আইডি এবং উপবৃত্তির জন্য বিবেচিত হলে উপবৃত্তির আইডি হিসেবে ব্যবহৃত হবে। এছাড়া জেলা শহরের পৌরসভা ও মেট্রোপলিটন এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলা ও সরকারি গেজেটভুক্ত অনগ্রসর ও পিছিয়ে পড়া উপজেলার শিক্ষার্থীদের শতভাগ শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব সিদ্বান্ত কার্যকর করতে অর্থমন্ত্রণালয় কর্তৃক স্কিমের ডকুমেন্ট সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ার সিদ্বান্ত হয়েছে।