সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির মাসিক ‘বাণিজ্য’ ৭০ লাখ টাকারও বেশি। ফুটপাতের হকার, লালদিঘীরপাড়ের পলিথিন, আবাসিক হোটেলের অপকর্ম, মদ-জুয়ার আসরসহ বিভিন্ন অপরাধ স্পট থেকে যোগান আসে বিপুল পরিমাণ এ ‘অবৈধ’ অর্থ। ১০ থেকে ১৪ লাখ টাকায় পোস্টিং নিয়ে আসার পরই ফাঁড়ির ইনচার্জ টাকার নেশায় ‘উন্মাদ’ হয়ে উঠেন। উপ-পরিদর্শক আকবর হোসেন ভূইয়ার অপকর্মের বিষয়টি ফাঁস হবার পর বন্দরবাজার ফাঁড়ির ‘বাণিজ্যের’ বিষয়টি সামনে এসেছে। তবে নগর পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত উপ-কমিশনার বি.এম আশরাফ উল্ল্যাহ তাহের সিলেটের ডাককে জানিয়েছেন, এরকম তথ্যটি সঠিক নয়। টাকার বিষয়টি যারা বলছেন-তারাই বলতে পারবেন। কারো নিকট ‘ঘুষ বাণিজ্যে’র অভিযোগ থাকলে আমাদের নিকট দিতে পারেন।
এসএমপি’র কোতোয়ালী মডেল থানা থেকে মাত্র কয়েকশ’ গজ দূরে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির অবস্থান। এ ফাঁড়ি সংলগ্ন এলাকায় সিলেট সিটি কর্পোরেশন, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও বাসভবন, পুলিশ সুপারের কার্যালয় ও বাসভবন, জেলা ও মহানগর দায়রা জজ, মেট্রোপলিটন আদালত এবং চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অবস্থান। ফলে ফাঁড়িটির গুরুত্ব অনেক। সার্বক্ষণিক এ এলাকার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ফাঁড়ির কর্মকর্তাদের তৎপর থাকার কথা থাকলেও পদায়নের পর তারা টাকার নেশায় উন্মাদ হয়ে পড়েন। সম্প্রতি এ ফাঁড়ি সম্পর্কে এমন তথ্য দেশবাসীর সম্মুখে উঠে এসেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের সাথে আলাপ করে ফাঁড়ির কর্মকর্তাদের ‘টাকার পেছনে পাগল’ হবার বিষয়টি উঠে এসেছে। তারা এই এলাকার অপরাধ ও মাসোহারারও বর্ণনা দেন। ওই সূত্র জানায়, গত ৪ মে দুপুরে বন্দরবাজারের ফুটপাতের এক ব্যবসায়ীকে (মাছ বিক্রেতা) ধরে ফাঁড়িতে নিয়ে যান এ. এস. আই. অরুণ। লোক দেখানো অভিযান হলেও পরে ফাঁড়িতে নিয়ে লোকটির কাছ থেকে ১ হাজার ৫শ’ টাকা আদায় করে ছেড়ে দেয়া হয়। ১৫ এপ্রিল রাতে বারুতখানা থেকে নিরীহ এক ব্যক্তিকে বাসা থেকে ধরে কোতোয়ালী থানায় নিয়ে যান এস.আই আকবর। আকবরের কথামতো টাকা না দেওয়ায় ঐ ব্যক্তিকে ২১ পিস ইয়াবা দিয়ে মামলা দেয়া হয়। এ রকম অসংখ্য ঘটনা পুলিশেরই অভ্যন্তরীণ তদন্তে উঠে এসেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র সিলেটের ডাককে জানিয়েছে।
২০১৯ সালের ৬ নভেম্বর বন্দরবাজার ফাঁড়িতে ইনচার্জ হিসেবে যোগ দেন এস আই আকবর। রায়হান হত্যাকান্ডের ঘটনায় গত ১২ অক্টোবর তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। আকবরের প্রথম হলেও এ.এস.আই আশিক এলাহী বন্দরবাজার ফাঁড়িতে ২য় বারের মতো পোস্টিং পান। আশিক এলাহী আমদানির দায়িত্বে থাকলেও পুরো বিষয়টির দেখভাল করতেন আকবর।
সূত্রমতে, ১০ লাখ টাকায় বন্দরবাজার ফাঁড়িতে পোস্টিং নেন আকবর। এ.এস.আই. আশিক এলাহীকে এজন্যে দিতে হয়েছে প্রায় দেড় লাখ টাকা। এর ফলে তারা টাকার জন্যে বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নগরীর ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র বন্দরবাজার এলাকায় ৫ শতাধিক হকার প্রতিদিন ফুটপাতে বসেন। মাছ, সবজি, কাপড়-জুতা, পেঁয়াজ-রসুনসহ নানান ধরনের পণ্য বিক্রি করেন এসকল হকার। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এসকল হকারের কাছ থেকে জনপ্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা নেয়া হয়। এই হকারদের কাছ থেকেই প্রতিদিন লাখ টাকারও বেশি আমদানি করেন কর্মকর্তারা। এরপরেই রয়েছে লালদিঘীর পাড় ও বন্দরবাজারের পলিথিন। এই পলিথিন থেকেও প্রতিদিন ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা আদায় করা হয়। এর ফলে অবৈধ পলিথিন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সুরমা মার্কেট, বন্দরবাজার, লালবাজার, কালীঘাটের অন্তত ১০টি আবাসিক হোটেলে পতিতাবৃত্তির জন্যে নেয়া হয় মাসে ৪ লাখ টাকারও বেশি।
আবার বন্দর ও কোর্ট এলাকায় আসা ভাসমান পতিতারাও টাকা দেন। ফাঁড়ি এলাকায় নিয়মিত ৮টি জুয়ার বোর্ড বসে। সবচেয়ে বড় বোর্ডটি বসে তালতলায়। এই জুয়ার বোর্ড থেকে প্রতিদিন নেয়া হয় ৫ হাজার টাকা। শিলং তীরের ৩টি আস্তানা থেকে প্রতিদিন নেয়া হয় ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। অটো রিকসা স্ট্যান্ড থেকে আদায় করা হয় মাসিক ৩০ হাজার টাকা। মদ, গাঁজা ও ইয়াবা কারবারীরাও থেমে নেই। মাসিক ৮ থেকে ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে চলে তাদের রমরমা মাদকের কারবার। বন্দরবাজার কেন্দ্রীক ছিনতাইকারী চক্রও নিয়মিত বখরা দিতো বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যদের-এমন অভিযোগও রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বন্দরবাজার ফাঁড়ির সদস্যদের টার্গেট হচ্ছে- প্রতিদিন ভোর বেলায় সিলেটে বেড়াতে আসা লোকদের ধরে ফাঁড়িতে নিয়ে টাকা আদায়। এমন কোনো মাস বা দিন নেই যে এমন ঘটনা ঘটেনি। আবার রাস্তায় রিক্সা থেকে নামিয়ে ফাঁড়িতে নিয়ে ‘নিশী’ কন্যার সাথে ছবি তুলে টাকা আদায়েরও অনেক অভিযোগ রয়েছে। বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে ‘কথিত’ সাংবাদিকদেরও বিচরণ রয়েছে। সাংবাদিক নামের এসব দালাল প্রতিদিন ফাঁড়িতে নিয়ে আসা লোকজনের সাথে দালালী করে পুলিশের হাতে টাকা তুলে দেয়। অবশ্য রায়হান হত্যার পর ফাঁড়ির সামনে কথিত সাংবাদিকদের মোটর সাইকেল আর পার্ক করতে দেখা যায়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্রের দাবি, এসকল অপকর্মের সাথে আকবরের নাম ঘুরে ফিরে এসেছে। আকবর একা নন এই বাণিজ্যের সাথে আরো অনেকের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। সূত্রমতে, ক্ষমতার দাপটেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন আকবর।
সূত্রমতে, এস. আই. পদমর্যাদার আকবর নিয়মিত প্রাইভেট কার ব্যবহার করতেন। পুলিশ সূত্রের দাবি, নিয়মানুযায়ী এস.আই. পদমর্যাদার কোন কর্মকর্তা প্রাইভেট কার ব্যবহার করতে পারেন না।
সূত্রের দাবি, কেবল আকবরের আমলই নয়, গত কয়েক বছর ধরে এভাবেই চলছে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ি।
সুশাসনের জন্যে নাগরিক সুজন সিলেট জেলা সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির এই বাণিজ্যের বিষয়টি অনেক পুরনো এবং সকলেরই জানা। কিন্তু, কখনো কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নজির নেই। রায়হান হত্যার পর কিছু ঘটনা বেরিয়ে এসেছে। এ বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নজর দেয়া জরুরি। বিশেষ করে কর্মকর্তাদের ব্যাংক হিসাব বা সম্পদের বিবরণী তলব করলেই অনেকেরই আমলনামা বেরিয়ে আসবে বলে মন্তব্য তাঁর।
সুত্র: সিলেটের ডাক